শনিবার বিকেলে ওদের শর্ট লিস্টের শেষ মেয়েটিকে দেখতে ক্যাবে করে ওঁরা এসে হাজির হলেন সিরিটিতে প্রফুল্ল সেন কলোনির দেড়তলা একটা বাড়িতে। যারা ওঁদের অভ্যর্থনা করে বাইরের ছোটো ঘরটিতে বসালেন, তাঁরা সম্পর্কে মেয়ের দাদা বউদি। মেয়ের বাবা মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। মা একটু মোটার দিকে, জর্দা দিয়ে পান খাবার অভ্যেস। কেতকীকে উনি সাদর আমন্ত্রণ জানালেন পান সেবন করার জন্য কিন্তু কেতকী হাত জোড় করে জানালেন ও রসে তিনি বঞ্চিত।

প্রথম নজরেই কাকলিকে অপছন্দ করে বসলেন কেতকী। মুখটা একটু চ্যাপটা ধরনের, রং শ্যামলা বলা চলে আর চোখদুটো ছোটো। শাড়ি না পরে চিকনের কাজ করা সালোয়ার কুর্তা পরে ও কি নিজেকে স্মার্ট বলে জাহির করতে চায় ওর ভাবি শ্বশুড়- শাশুড়ি আর বরের সামনে? থার্ড ডিভিশানে যে-মেয়ে পাস কোর্সে বিএ পাশ করেছে তার চাকরি জুটবে কী করে? তাই ছাতের ঘরে দুই ব্যাচে গোটা দশেক পাড়ার বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের হাত খরচাটা উঠিয়ে নেয় কাকলি।

মেয়ের দাদা বিকাশ কুঁদঘাটার একটা শাড়ির দোকানে সেল্সম্যান। এই পরিবারের মাসিক আয় যে পনেরো হাজার টাকার উপরে হবে না— সেটা বুঝতে অবিনাশ এবং কেতকীর কোনও অসুবিধে হল না। এই পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা তাতে এ ঘরে বিয়ে হলে মেয়ের হাতে, গলায়, কানে পরাবার মতো গয়নার ব্যবস্থা ওরা করতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ জাগতেই পারে কেতকীর মনে!

কাকলিকে শর্ট লিস্টে রাখার পেছনে অরিত্র আর আবিনাশবাবুর একটাই যুক্তি ছিল— চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে মেয়েটার। শুধু ওদের দু’জনের সন্মান রক্ষা করতেই চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে কেতকী জানতে চাইলেন ও রান্নাবান্না জানে কিনা৷ কাকলি সরাসরি কেতকীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ের পর ও কাজটা তো সব মেয়েকেই করতে হয় মাসিমা। কিন্তু আমরা তো বাঙাল, আমার রান্না কি আপনাদের পছন্দ হবে?

কাকলির বউদি শম্পা আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘কেন তুই তো ঘটিদের রান্নাও জানিস। বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত করে খাওয়ালি সেদিন, খুব ভালো হয়েছিল।’

—সে আমাদের রান্না না হয় শিখিয়ে নেওয়া যাবে, বললেন কেতকী। আর বেশি সময় দিতে রাজি নন উনি এ দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে এই বেলা জিজ্ঞেস করে নে খোকা। আমাদের আবার শপিং করতে যেতে হবে তো।’

অরিত্র মাথা তুলে ওর দিকে তাকাতেই ওকে চোখ মারল কাকলি। অরিত্র প্রথমে ভাবল মেয়েটা হয়তো একটু ট্যারা তাই… কিন্তু মেয়েটা যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তাতে বুঝল, ও ভুল দেখেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার ওর বাবা-মা কেউই লক্ষ্য করেননি মেয়েটার এই শরারতি।

গেস্টহাউসে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে মা-বাবা টিভির সামনে বসে গেলেন আর অরিত্র চলে গেল ব্যালকনিতে। পথে আসতে আসতেই মা জানিয়ে দিয়েছিলেন বেলেঘাটার মেয়ে শুভমিতাকেই ওঁর পছন্দ আর বিয়ের ব্যাপারে বাবার নয়, মার পছন্দটাই যে শেষ কথা, সেটা অরিত্রও ভালো ভাবেই জানে।

শুভমিতাকে অরিত্র-র খারাপ লাগেনি, খারাপ লাগেনি বাগুইআটির বর্ণালিকেও। ওদের দু’জনেরই কিছু গুণ এবং ক্ষমতা আছে যা হয়তো তার নেই। অরিত্রর মনে হয় বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা ব্যাপারটাই একটা মধ্যযুগীয়, কুৎসিত সামাজিকপ্রথা কিন্তু একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য যে সাহস, সময় এবং উদ্যোগের প্রয়োজন তা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি অরিত্র। আর সেই জন্যই এই নোংরা প্রথাটাকে মেনে চলতে হচ্ছে ওকে।

কিন্তু কাকলি নামের মেয়েটি তাকে চোখ মেরে বসল কেন? ও কি তাকে ঠাট্টা করল মা বাবার সঙ্গে মেয়ে দেখতে এসেছে বলে? নাকি ওর অন্য কোনও মতলব আছে? অনেক রাত পর্যন্ত কাকলির চোখ টেপার পিছনে কী হেঁয়ালি আছে বুঝবার চেষ্টা করে ঘুমিয়ে পড়ল অরিত্র।

পরের দিন সকাল ন’টা নাগাদ ফোনটা এল অবিনাশবাবুর কাছে। কেতকী তখন বাথরুমে৷ ‘ও হ্যাঁ, ও কাছেই আছে, দিচ্ছি ওকে।” অবিনাশবাবু মুচকি হেসে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন অরিত্রর দিকে। ‘নাও কথা বলো কাকলির সঙ্গে’, অবিনাশবাবু বললেন গলা খাটো করে। ‘হ্যাঁ বা না বলার দরকার নেই এখন।’

অরিত্র ভাবতে পারেনি কাকলি ওকে সরাসরি ফোন করবে। ‘হ্যালো’ বলতেই কাকলি বলল, ‘অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই, বুঝতে পারছি। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই— ফোনে নয়, সাক্ষাতে। কখন কোথায় আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন যদি বলেন।’

—বিকেলে আমাদের ফ্লাইট, কাজেই দেখা করতে হলে এখনই দেখা করতে হয়, অরিত্র বলল। কিন্তু আপনি তো সিরিটিতে থাকেন আর আমি এখন সল্টলেকে।

—নো প্রবলেম। মাঝামাঝি কোনও জায়গায় দেখা করতে পারি আমরা। আমি যদি মেট্রোতে পার্ক স্ট্রিট এসে যাই?

—তাই করুন। পার্ক হোটেলের সামনেই দাঁড়াবেন। সাড়ে দশটা, ঠিক আছে?

—একদম। অনেক ধন্যবাদ।

                                                                                                                                        চলবে…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...