পর্ব ২

মণি ঘোষাল গল্প কবিতার বাঘ-সিংহ-ভল্লুক সব একসাথে। কলম দিয়ে কলকল করে কাব্যি ছোটে ঝরনাধারার মতো। এককালে তার নাকি দুর্ধর্ষ এক গুরু সঙ্গ হয়েছিল। ওর মতো আর কেউ নাকি গুরুকে তেমন করে পায়নি। আর গুরুও মণি বলতে অজ্ঞান ছিল। তা সেই গুরুই একদিন সত্যি সত্যিই মণির একটা কবিতা পড়তে গিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মুখে লালা উঠে এই মরে কি, সেই মরে অবস্থা! অন্য যারা ছিল তারা গুরুকে হাসপাতালে গ্যারেজ করাতে কোনও মতে সে যাত্রা গুরুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়নি।

তা মণি নাকি কবিতার কাটাছেঁড়ায় অদ্বিতীয়ম বলে মনে করে নিজেকে। এটাকে সে তার গুরুর দান বলেই ভাবে। কবিতার নাড়িভুঁড়ি ঘেঁটে সে তার পেটের কথা বার করে নিয়ে আসবে। হুঁ হুঁ বাবা কারওর নিস্তার নেই! বিটকেল হিংসুটে সতীর্থরা বলে— ও ব্যাটা নিজে কোনওদিন একটা সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে পারেনি আজ পর্যন্ত। আর সে করে কিনা সমালোচনা! কালে কালে কতই হল, পুলি পিঠের ল্যাজ গজাল। যাইহোক, তা বলে সাহিত্যচর্চায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা পাওয়াতে কোনও ঘাটতি ছিল না, আর এগুলো সে পেয়েছে ঠিক তারই মতন অন্যান্য সব সম্পাদকদের থেকে।

এখন নভেম্বর। হালকা শীতের আমেজ পোশাক চুঁইয়ে শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে শিরা উপশিরা ছাড়িয়ে অন্তরে অন্তরে। সামনের এপ্রিল আসতে হাতে আর মাস পাঁচেক মতন। সামনের পঁচিশে বৈশাখে এবার অন্তত পাঁচখানা বই প্রকাশ করতেই হবে। তবে মলাট উন্মোচনে এবার এমন সব আনকমন এক একজন থাকবে না, যা দেখে সবাই চমকে (পড়ুন ঘাবড়ে যাবে! মণি ওর ফিল্ডের পাকা মাথার লোক। টিকে থাকতে হলে যা যা করার দরকার, সবই করে সাধ্যমতো এবং পরিকল্পনা মাফিক।

একটা নেটওয়ার্ক ভালো মতন তৈরি করেছে আশেপাশের দু’তিনটে জেলা জুড়ে। সেখানের বিভিন্ন অঞ্চলে এক একজন কবি সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করে। তারা নতুন লেখক জোগাড় করে, প্রকাশিত বই পুশসেল করে। মণি অবশ্য পরিশ্রম করে যথেষ্ট। ফোনে যোগাযোগ তো থাকেই তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ওইসব জায়গায় গিয়ে সাহিত্যবাসরও বসায়। দরকার হলে এক আধদিন থেকেও যায় সেখানে। দূরের কবি সাহিত্যিকরাও মণির আসানসোলে আসে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মার্চ নাগাদ দু’দিন ব্যাপী চলা আসানসোল লিটলম্যাগের মেলাতে তো আসবেই আসবে। আপাতত তিনটে বইয়ের মেটেরিয়াল প্রায় হাতের মুঠোয়। এখানকার বলতে তনুরটা আর বাকি দু’টোর একটা সিউড়ি আর একটা বাঁকুড়ার। এর মধ্যে একটা ছোটোগল্পের সংকলন, অন্য দু’টি কবিতার।

ফেসবুকে লেখার সূত্রে এখন অনায়াসে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা ফেটে বেরোতে পারছে জনসমক্ষে। মন্দ না। যেমন সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন— বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান/ আমার বর দেখতে এমন যেমন জাম্বুবান। অথবা, সেদিন গোধূলিবেলা/ তোমার রাঙা ঠোঁটে আমার ওষ্ঠ চকাম চকাম করিছে খেলা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মণি মূলত ফেসবুক ঘেঁটে এই জাতীয় কবি লেখকদেরকে ট্যাপ করে। প্রথমে মেসেঞ্জারে প্রশংসা তারপরে ফোন, তারপর সোজা কবির বাড়িতে হানা। মহিলা কবি হলে তো সোনায় সোহাগা। বরের সামনে বউ-কবির কবিতার ফাটিয়ে প্রশংসা। দুপুরে গান্ডেপিন্ডে খাওয়াদাওয়া তারপর একটা জম্পেশ ঘুম। বিকেলে স্ন্যাক্স সহযোগে চা সাঁটিয়ে খানকতক কবিতা ব্যাগে পুরে নিয়ে চলল মদন। তনুকে মণি এভাবেই কবি বানিয়েছে। তনু বলেছে ওর কয়েকজন বন্ধুও লেখালেখি করছে ফিলহাল। মণি বলেছে— তা ওদেরকেও পরের কবিতা পাঠের আসরে নিয়ে এসো না। তনু রাজি হয়েছে বলেছে, দেখি যোগাযোগ করে। আপনাকে জানাব। তনু, ওর বন্ধু মানে রূপা গোপা সীমা আর মণিকার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ওরা খুবই আগ্রহী।

একদিন রোববার বিকেলে বিগবাজারে, ওদের সবার সঙ্গে সপরিবারে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। আর যায় কোথা! ওরা সবাই যে যার বরকে কেটে পড়তে বলল। তারপর সোজা চারতলার ফাঁকা একটা খাবার দোকানের একটি টেবিল দখল করে পাঁচটা ঠান্ডা পানীয় নিয়ে গল্পে মেতে উঠল।

বেচারা বরসকল একটা চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা আর মুখে সিগারেট নিয়ে হোস্টেল জীবনের স্মৃতিচারণে মিনিট কুড়ি পঁচিশ কাটিয়ে যে-যার মতন যাবার তোড়জোড় করছে, ঠিক তখনই তনুর বর বলল, ‘জানিস তো তনু লেখালেখি করছে। কিছু টাকা গচ্চা যাচ্ছে বটে তবে শালা মুক্তি পেয়েছি বলতে পারিস একরকম। কাজকম্ম নেই শুধু ভুলভাল বকত আর আমার মাথা চেটে সাফ করে দিত। এখন মাঝে মধ্যে দু’একটা আগডুম বাগডুম লেখা শুনে বাঃ বাঃ বলে দিলেই ছুটি।’

বাকিরাও সবাই বলল— বাব্বা তুমি একা নও আমরাও তোমার মতনই ওই একই পথের পথিক। তবে এখন আছি বিন্দাস কিন্তু বস! বেঁচে থাকুক ওদের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা— তাতে যদি হয় হোক আমাদের খরচা। তনুর বর অনুপম বলল— আরিব্বাস বস তুমিও তো দেখছি কাব্যি করে কথা বলছ, কী ব্যাপার রূপার ছোঁয়া লেগেছে মনে হচ্ছে।

বিরূপাক্ষ প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠেছে— আরে না না… ওটা বাইচান্স মিলে গেছে, এই আর কি!

—আমি? তাও আবার কাব্যি! বাংলায় প্রায় ফেল মারতে মারতে পাশ করে গেছিলাম হায়ার সেকেন্ডারিতে কোনওরকমে।

এদিকে তনুদের আড্ডা জমে উঠেছে। তনু বলল— হ্যাঁরে তোদের চারজনের লেখা কবিতা আমি ফেসবুকে পড়েছি। তোরা কী ভালো লিখিস রে৷ ফেসবুক না থাকলে তো কোনওদিন জানতেই পারতাম না। এই শোন তোদেরকে না বলা হয়নি, জানিস তো আমার না একটা কবিতার বই বের হচ্ছে।

—ওহ তাই নাকি তাই নাকি। তা কবে?

—মণিদাই সব করছে। এই সামনের পঁচিশে বৈশাখ। শোন না মলাট উন্মোচনের দিন কিন্তু আমি তোদের সবাইকে অনুষ্ঠানে চাই।

রূপা বলল— আচ্ছা, দিদি কমপক্ষে কতগুলো কবিতা হলে একটা বই করা যেতে পারে?

—অতটা তো জানি না। তবে আমারটা করতে মণিদা সত্তর থেকে বাহাত্তরটা দরকার বলেছে। তা’ তুই বের করবি নাকি একটা?

—হ্যাঁ দিদি হতে পারে। আমার স্টকে এখনই প্রায় সত্তর আশিটা হয়ে যাবে।

—বলিস কী রে? তাহলে করে ফেল। মণিদাকে বলি ?

—দাঁড়াও। দু’টো দিন ভেবে নিই। তা খরচ খরচা কেমন গো?

—তেমন কিছু না। ওই পঞ্চাশ মতো সাকুল্যে!

গোপা সীমা মণিকাও ততক্ষণে জেগে উঠেছে। তাহলে তো অতগুলো কবিতা আমারও আছে। আমারও আছে করে কলকল করে উঠল ওরা সকলে।

তনু বলল— থাম থাম। ধীরে। এক কাজ কর তোরা। সামনের সপ্তাহে একটা সাহিত্যবাসর হচ্ছে। চল না তোরা। মণিদা এমনিতেই বলেছে আগ্রহী বন্ধুদেরকে নিয়ে যেতে। রেডি থাকিস বেলা এগারোটা নাগাদ আমি তোদের প্রত্যেককে বাড়ি থেকে তুলে নেব আমার গাড়িতে। তোদের সবাইকে আর আলাদা করে গাড়িতে যেতে হবে না। তাহলে ওই কথাই রইল। ততক্ষণে তো ওদের সবার মনে ওই যাকে বলে লাড্ডু ফুটতে আরম্ভ করেছে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...