আমরা সবাই জানি যে, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। মূলত পৃথিবীর ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় এলাকার দেশগুলিতে দেখা যায় এই রোগ। যদিও আজকের পৃথিবীতে এই রোগটি অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই অল্পবিস্তর ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সবার সুস্থতার জন্য এই রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং সুস্থতায় ফেরার পরামর্শ দিলেন ডা. অতনু কুণ্ডু।
ডেঙ্গুর অন্য নাম ব্রেক বোন ফিভার (break bone fever)। কারণ এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সংযোগস্থলে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। এই রোগের জীবাণু বহনকারী এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়ের ফলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ৷ আসলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত মানুষকে এডিস মশা কামড়ালে মশাটি সংক্রামিত হয়। এডিস মশা প্রকৃতপক্ষে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। এরপর সে অন্য কোনও সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তিনি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন। সাধারণত মশা কামড়ানোর চার থেকে দশ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায় মানব দেহে। এর প্রাথমিক লক্ষণ ফ্লু বা অন্য সাধারণ জ্বরের মতোই।
১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট শারীরিক তাপমাত্রা, মাথার যন্ত্রণা, হাড় এবং মাংসপেশিতে ব্যথা এবং শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে যন্ত্রণা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, চোখের ভিতরে ব্যথা, গায়ে চুলকানির ভাব ইত্যাদি লক্ষণ ডেঙ্গুকে অন্য জ্বরের থেকে আলাদা করে। একমাত্র উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একজন চিকিৎসকই পারেন ডেঙ্গুর সংক্রমণ সনাক্ত করতে।
সাধারণ ভাবে ডেঙ্গু সংক্রমণ দুই থেকে সাত দিন থাকে। কিন্তু ডেঙ্গু জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে ওঠে যখন রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা খুব কমে যায়। ডেঙ্গু শক এবং হেমোরেজিক ফিভারের লক্ষণগুলি হল— নাক ও দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তপাত, বমি বন্ধ না হওয়া, মল-মূত্র-বমির সঙ্গে রক্ত আসা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। এক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধী টিকা পাওয়া যায় কিন্তু এর কার্যকারিতা সেই ভাবে প্রমাণিত নয়।
প্রকৃতপক্ষে সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট (supportive treatment) ছাড়া সেই অর্থে ডেঙ্গুর কোনও ওষুধ এখনও নেই। একটি উল্লেখযোগ্য এবং কিছুটা স্বস্তিদায়ক বিষয় হল যে, ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়, অর্থাৎ মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি ছড়িয়ে পড়ে না যদি না ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী মশা কামড় দেয়। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধের সব থেকে কার্যকরী উপায় হচ্ছে মশার কামড় থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা এবং বাড়ির আশপাশে কোনও স্থানে বা পরিত্যক্ত পাত্রে জল জমতে না দেওয়া।
এতক্ষণ ডেঙ্গু কী, কীভাবে ছড়ায় ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হল। কিন্তু যে-বিষয়টা একটু অবহেলিত থেকে যায় তা হল— ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর ডেঙ্গুজনিত শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ এবং তা পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ। পোস্ট ভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম (Post-viral fatigue syndrome) বা পোস্ট ডেঙ্গু কমপ্লিকেশন সিনড্রোম (Post-Dengue complication syndrome)-এর ফলস্বরূপ খিদে কমে যায়, ওজন কমে যায়, অত্যধিক ক্লান্তি বোধ হয়, এমনকী হার্ট, কিডনি, ব্রেনেরও ক্ষতি হয়। এর থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য কতকগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজনীয়—
১) সুষম খাবার
ডেঙ্গু আক্রান্তের সুস্থ হওয়ার জন্য সুষম খাবারের একান্ত প্রয়োজন। এই খাবারে প্রোটিন ও ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, টাটকা শাকসবজি— খাদ্যতালিকায় থাকা একান্ত প্রয়োজন। তবে এগুলি স্বাস্থ্যকর ভাবে কম তেলমশলা দিয়ে রান্না হতে হবে। সঙ্গে সাধ্যমতো ফলমূল খেতে হবে। জাঙ্ক ফুড বা বেশি তেলে ভাজা খাবার একান্ত ভাবে পরিত্যাজ্য, কারণ ডেঙ্গু আক্রান্তের লিভার সাময়িক ভাবে দুর্বল হয়। ফলে বেশি তেলমশলা-যুক্ত খাবার এবং জাঙ্ক ফুড খেলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর সুষম, সহজপাচ্য খাবার নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়ম মেনে খেতে হবে, যা পুষ্টির সহায়ক এবং আক্রান্তকে স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় ফিরতে সাহায্য করবে।
(২) জল এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় গ্রহণ
ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত সুস্থ হওয়ার আরেকটি শর্ত প্রচুর পরিমাণে জল এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় গ্রহণ। সারাদিনে অন্তত ২ থেকে ৩ লিটার পরিশুদ্ধ জল পান করতে হবে। ঘরোয়া একটি পদ্ধতি এক্ষেত্রে অনুসরণ করা যেতে পারে। জলের পাশাপাশি আলাদা ভাবে আখ, পাতিলেবু, কমলালেবু, বেদানার রস এবং বিশেষত ডাবের জল খেলে তা শরীরকে শক্তি যোগায় এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ফলে যে-ভিটামিন ও খনিজের ক্ষয় হয়, তা পূরণ হয়। এক কথায়, ডেঙ্গু আক্রান্তের সুস্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হাইড্রেটেড (hydrated) থাকা।
(৩) পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম
পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হওয়ার আরেকটি শর্ত। পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম করা, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করা, হালকা ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা শরীরে সঠিক ভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে সাহায্য করে এবং নার্ভগুলিকে সক্রিয় রাখে। পরিমিত পরিশ্রম বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ খিদে বাড়ায় এবং ঘুমে সাহায্য করে।
(৪) মাল্টিভিটামিন থেরাপি
যদিও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বিভিন্ন ফলের রসের মাধ্যমে ভিটামিনের ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়, তবুও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে উপযুক্ত মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট বা সাপ্লিমেন্ট খাওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।
(৫) পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম
সর্বোপরি ডেঙ্গু আক্রান্তের দ্রুত সুস্থ হওয়ার পক্ষে সহায়ক পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম— যা ডেঙ্গুর কারণে যে-ক্লান্তি গ্রাস করে আক্রান্তকে তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম আক্রান্তকে দ্রুত শারীরিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে এবং তাকে পুনরায় কর্মক্ষম করে তোলে।
এখন ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রবল মাত্রায় চলছে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই কিন্তু একইসঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে। জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং তার নির্দেশ কঠোর ভাবে পালন করতে হবে। আর যা করণীয় তা হল— মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাড়ির আশপাশে খানাখন্দে বা পরিত্যক্ত পাত্রে জল না জমতে দেওয়া।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন সকলে। ডেঙ্গু নিয়ে নয় অবহেলা, নয় আতঙ্ক, থাক সতর্কতা।