পর্ব – ২
অসতর্ক মুহূর্তের সব ফেলে আসা কথা। আমাকে আবির মাখিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইছিল আবির হাতে আমাকে, ওর শরীরের দখল নেওয়ার জন্য। তবে বিজলির সাথে আমার সম্পর্ক চরমে পৌঁছে ছিল সে বছর বড়োদিনের দিন। যখন ও আমায় মহুয়া খাবার পর জঙ্গলের পথ ধরে রাতেরবেলা বাড়ি পৌঁছে দিতে আসছিল।
খরস্রোতা কিশোরীর মতো পাহাড়ি ঝরনা দুকুল ছাপিয়ে উপচে পুরো পাহাড় ভিজিয়ে দিয়েছিল সেদিন। পাহাড়ের কোলে শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর আধখাওয়া চাঁদের দুধ গড়িয়ে পড়েছিল আমাদের দু’জনের গা বেয়ে। পাহাড়ি ঝরনার সাদা ফেনার মতো আমার ফরসা শরীরে কালো পাহাড়ের মতো বিজলি চেপে বসেছিল। পাহাড়ের বুক ফেটে ঝরনা নেমে এসেছিল আদিম গহ্বর থেকে শহুরে সভ্যতার বুকে। ব্যস! সেই শেষ রাত। তারপর আর বিজলির সাথে সেভাবে কোনওদিন যোগাযোগ হয়নি। কারণ দু’পক্ষেরই বাড়ির চাপে অবাধ মেলামেশার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল। তবে শেষ দেখা হয়েছিল, বাবা যেদিন বদলি হয়ে গেল। তখন আমি কলেজ শেষ করেছি সবে। ও দূরে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতো। যার বুকে অনেক হিমবাহ জমে আছে।
শুধু দু’চোখের কোণা বেয়ে তিরতির করে গড়িয়ে পড়ছে ঠিক কোয়েল নদীর মতো একটা ক্ষীণ ধারা। তারপর এই আবার এখানে এলাম বছর দুই পর। শীতের ছুটিতে। ছোটোবেলার শিকড়ের টানে। তবে তখন পাহাড় আর তার এই উপত্যকার ছবি এক থাকলেও রং পালটে গেছে অনেক। তবে এসে যা শুনলাম, তাতে বুঝলাম, তার জন্য দায়ী ওরা নয়। দায়ী আমরাই, শহুরে মানুষেরাই।
এবার বাঁক নিয়ে গল্পের শুরুর দিকে আবার ফিরে যেতে হবে। এ বছর আমি এসেছি বড়োদিনের ছুটিতে। এসে উঠেছি বাবারই এক বন্ধুর কোয়ার্টারে। ওনার ছেলে সিদ্ধার্থ আবার আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা দু’জনেই গিয়েছিলাম বড়োদিনের সন্ধেবেলা আদিবাসীদের গ্রামে। ওখানে সব ছোটোবেলাকার খেলার সাথি এখনও কিছু আছে। তবে সিদ্ধার্থ প্রথমে যেতে চাইছিল না। তার কারণ ও যা বলল, আমি তো শুনে অবাক। ওর কথাটাই এখানে হুবহু তুলে ধরি।
—শোন শুভজিৎ, তোর এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু জানা দরকার। তোরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পর, অনেকেই কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেল। তুই আগের ধারণা নিয়ে এখানে এখন ঘোরাফেরা করলে বিপদ হতে পারে। তাই আগে থেকেই তোকে একটু সাবধান করে দিচ্ছি।
—বিপদ! আমাদের এই উপত্যকা তো স্বর্গরাজ্যের মতো সুন্দর ছিল। সেখানে আবার সমস্যা কী হল?
—না… আগে তো সত্যিই কোনও ঝামেলা ছিল না। কিন্তু এখন কারখানাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। নানারকম অশান্তিও শুরু হল একটার পর একটা। প্রথমে যেটা ঘটল, সেটা ভয়ংকর। তোরা চলে যাবার মাসখানেক পরেই। তুই তো জানতিস হাতিশালায় প্রতি হাতিপিছু দশ কেজি করে আটা দিনে বরাদ্দ ছিল। সেই আটা চুরি করত প্রভাকরদা, মানে প্রভাকর মাহাতো। চিনতে পারছিস তো?
—হ্যাঁ, চিনব না কেন? প্রভাকরদাই তো হাতিদের মাহুত ছিল। আমাকে কতবার হাতির পিঠে চড়িয়েছে।
—হ্যাঁ ঠিক। জানিস তো হাতিরা এমনিতেই খুব সংবেদনশীল আর বুদ্ধিমান। ওদের আধপেটা খেয়েই দিন কাটত। একদিন এক আদিবাসী সাফাইওয়ালা যেই না ঢুকেছে হাতিশালা পরিষ্কার করতে। আর ব্যস! তখনই একটা হাতি শুঁড়ে করে পেঁচিয়ে তাকে দেয়ালে ঠেসে পিষে মেরে দিল। সেই প্রথম খেপল আদিবাসীরা। আসলে প্রভাকরদার অসততায় বিনা দোষে একজন আদিবাসী মারা গেল।
—তারপর?
—তোর রমণীকাকুকে মনে আছে?
—হ্যাঁ রমণীমোহন কর। ডলোমাইট খনির ক্যাশিয়ার ছিল।
—তুই তো জানিস। রমণীকাকুর স্বভাব চরিত্র কোনও দিনই ভালো ছিল না। নিরক্ষর মজদুরদের হিসেব গুলিয়ে সবাইকে পয়সা কম দিত। ঠকাত। আর একটা রেজা (মহিলা কুলি) ছিল, একটু ধোঁড়ো গোছের, নাম লছমী এক্কা। তোর মনে আছে?
আমি হাসলাম। কারণ এই ‘ধোঁড়ো’ হল এই অঞ্চলের ভাষা। মানে শহুরে লোকেরা যাদের আর কী হস্তিনী নারী বলে। শ্রাবণের পুকুরের মতো টইটুম্বুর। হেসে বললাম, ‘ওই বয়সে লছমীকে কি ভোলা যায়?”
—সেই লছমীর সাথেই রমণীকাকুর লটরপটর, আদিবাসীরা একদিন হাতনাতে ধরে ফেলেছিল। তারপর সেটা নিয়ে বিরাট গণ্ডগোল হয়। মোটামুটি আদিবাসীদের সঙ্গে শহুরে মানুষদের একটা শ্রেণিশত্রুতার বীজ তখনই বোনা শুরু হয়ে গেল। আচ্ছা একটা কথা সত্যি করে বলতো, “তুই কি সত্যিই বিজলিকে ভালোবাসতিস?’
—ভাই আমাকে আবার এসবের মধ্যে জড়াচ্ছিস কেন? তবে একটা আগ্রহ চেপে রাখতে পারছি না, হ্যাঁরে সেই বিজলির কোনও খবর জানিস?
—এই তো গুরু, এবার পথে এসো। শোন, তোর আর বিজলির ব্যাপারটা নিয়েও পরবর্তীকালে আলোচনা হয়েছিল। আসলে এইসবের নাটের গুরু হল বুধিয়া। ও মনে মনে বিজলিকে খুব ভালোবাসত। যেটা আমি পরে বুঝতে পারি। যদিও বিজলি ওকে খুব একটা পাত্তা দিত না। তুই না চলে গেলে, ও হয়তো তোকে শেষই করে দিত।
—না না, বুধিয়া আমার ভালো বন্ধু ছিল।
—ভুল করছিস। প্রেম মানুষকে অন্ধ আর বুদ্ধিহীন করে দেয়। কারণ বিজলিও তোকে খুব ভালোবাসত।
—ওসব ছাড়! যে-সম্পর্কটা আমার বাবা-মা বা ওদের সম্প্রদায়, কেউই মেনে নেবে না, সেটা নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ কি? তার চেয়ে বরং ওদের খবর বল।
—দ্যাখ, বুধিয়া আমাদের সাথে ওই পাহাড়ি আদিবাসীদের সম্পর্কের যাবতীয় ফাটলের জন্য একমাত্র দায়ী। বুধিয়া স্কুল পাশ করে রাউরকেল্লা কলেজে ভর্তি হল। ঠিক তারপর থেকেই ওর ভেতর একটা পরিবর্তন হতে শুরু করল। মনে হয় কলেজে কেউ ওর মগজ ধোলাই করেছিল। কোনও আদর্শবাদী দলের সব নীতিকথা ওর মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। ও তলে তলে অনেক আদিবাসীকেই নিজের দলে টানতে শুরু করল। কিছু মেয়েও ওদের দলে ভিড়ল। তুই তো জানিস, ওর ছোটোবেলা থেকেই ধূর্ত শিকারির মতো প্রখর চোখ। বিজলিকেও হাত করে নিল মগজ ধোলাই করে। শুনেছি ওরা সবাই নাকি এক নিষিদ্ধ সংগঠনে যোগ দিয়েছে। এখন ওরা ওই পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। পুলিশ ওদের খুঁজছে। তাই ওপর থেকে তুই কিছুই বুঝবি না। ক’দিন থাকলেই সব টের পাবি, চারদিক থমথম করছে। সেই অনাবিল আনন্দ আর নেই রে…
আমি সব শুনে বাকরুদ্ধ। শুধু একটা ঢোঁক গিলে বললাম, ‘তার মানে আদিবাসীদের গ্রামে যাওয়া যাবে না?”
—তুই কলকাতা থেকে এত আশা করে এসেছিস। কী বলি বল! তবে গেলেও বেশি রাত করা যাবে না। সাবধানে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে।
ক্রমশ…