পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের কিছুদিন পর রাজমহলে ধরা পড়েন সিরাজ গুপ্তচরের মাধ্যমে। ক্লাইভের সহায়তার মীরজাফর তখন বাংলার নবাব। মীর দাউদ ও মীরকাসেম খান দ্বারা বন্দি সিরাজকে নিয়ে আসা হয় মুর্শিদাবাদে। মীরজাফর পুত্র মীরণ, সিরাজের দেখাশুনার দায়িত্ব নিলেন। ওই রাতেই মীরণের নির্দেশে মহম্মদী বেগ বন্দি সিরাজকে হত্যা করে পলাশী চক্রান্তের বৃত্ত পূর্ণ করেন।

আমরা এবার পৌঁছোলাম মাটির নীচে অবস্থিত এক গোপন কক্ষে, যেখানে অবৈধ ব্যাবসার পরিকল্পনা করা হতো। জগৎ শেঠদের বাড়ি ১৯৮০ সালে মিউজিয়ামে পরিণত হয়। এখানে বিভিন্ন ঘরে সাজানো রয়েছে জগৎ শেঠ পরিবারের ছবি, পূর্বের ও তৎকালীন মুদ্রার সংগ্রহ, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, বহুমূল্যের সব পোশাক এবং সোনা-রুপোয় খচিত অসাধারণ কয়েকটি বেনারসি শাড়ি। নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলেও এই মিউজিয়াম রাজ্যের অন্যতম সংরক্ষিত স্মারক। চমকপ্রদ ইতিহাসকে মনে রেখে অটোতে এসে বসলাম।

কয়েক মিনিট পরে অটো এসে থামল নসিপুর রাজবাড়ির সামনে। প্রথম দর্শনেই রাজবাড়ির সঙ্গে বিখ্যাত হাজারদুয়ারি প্যালেসের সাদৃশ্য খুঁজে পেলাম। ব্রিটিশ আমলের কর সংগ্রাহক দেবি সিং-এর ভাইপো রাজা উদ্বন্ত সিংহ এবং তাঁর ছেলে রাজা কীর্তিচন্দ্র সিংহ দ্বারা তৈরি এই প্রাসাদের সম্মুখ অংশে গ্রীক ও রোমান স্থাপত্যরীতির মিল পাওয়া যায়।

এরপর গেলাম জাফরাগঞ্জে ‘১১০০ কবর স্থান’-এর কাছে। এই সমাধিক্ষেত্র মীরজাফর বংশের পারিবারিক কবর স্থান, যেখানে নাকি ১১০০টি কবর রয়েছে। মাথাপিছু ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম কবরস্থানে। পাঁচিলে ঘেরা অনেকটা জায়গা জুড়ে সারিবদ্ধ কবরগুলি। মীরজাফরের কবর ছাড়াও তাঁর পিতা, দুই বিধবা পত্নী, আলিবর্দী খাঁর বোনের কবরও রয়েছে এই সমাধি ক্ষেত্রে। মীরজাফরের বড়ো পুত্র মীরণ এবং মীরকাশিম ছাড়া ওই বংশের সব নবাব ও নাজিমদের কবর সংরক্ষিত আছে সেখানে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থান খোসবাগ।

প্রায় ১৫ মিনিট অটো চেপে এসে পৌঁছোলাম ভাগিরথীর পূর্ব তীরে অবস্থিত লালবাগের অন্তর্গত জিয়াগঞ্জ এলাকায় খোসবাগের অবস্থান। অটো থেকে নেমে মাথাপিছু ২০ টাকার টিকিট কিনে বিশাল এক বার্জ-এ চড়ে পৌঁছে গেলাম নদীর পশ্চিম পাড়ে। বার্জ থেকে নেমে, একটু হেঁটে এসে বসলাম অটোয়। খোসবাগের পথে একটু এগোতেই বাঁ দিকে রাস্তা চলে গেছে হীরাঝিল ও সিরাজদৌল্লার মনসুরগঞ্জ প্রাসাদের দিকে। মাত্র ৬-৭ মিনিট পরেই পৌঁছে গেলাম খোসবাগে, নবাব আলিবর্দী খাঁ এবং তাঁর দৌহিত্র তথা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, সিরাজদৌল্লার সমাধিস্থলের প্রবেশদ্বারে।

খোসবাগে এসে মনে হচ্ছে, পাঠকদের নবাব আলিবর্দী খাঁর রাজত্বকালের কয়েকটি কথা না জানালে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা নবাব সুজাউদ্দিনের বেগম জিন্নতউন্নেসা মনস্থির করেছিলেন আলিবর্দী খাঁকে বিহারের ছোটো নবাব করার। সরফরাজ রয়ে গেলেন বাংলার দেওয়ান। আলিবর্দী খাঁ বিহারের ছোটো নবাব হওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগমের এক পুত্র সন্তান হয়। আলিবর্দী প্রিয় দৌহিত্রের নাম রাখলেন মির্জা মহম্মদ যিনি পরবর্তী কালের নবাব সিরাজদৌল্লা।

সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর নবাব হলেন তাঁর অপদার্থ পুত্র সরফরাজ। বিভিন্ন কারণে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ শুরু হল অমাত্য হাজি আহম্মদ, দেওয়ান আলমচাঁদ এবং ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠ ফতেচাঁদের। একই বছরে দ্বিতীয়বার রাজস্ব প্রদান নিয়ে নবাব সরফরাজের সঙ্গে মতবিরোধ হল দিল্লির দুর্বল সম্রাট মহম্মদ শাহের। সরফরাজ দ্বারা অপমানিত হাজি আহম্মদ সেই সুযোগে ভাই আলিবর্দী, আলমচাঁদ ও জগৎ শেঠের সঙ্গে যুক্তি করলেন। তাঁরা সম্রাটকে দিলেন উৎকোচ এবং সেই বছরেই রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং তার বিনিময়ে চাইলেন বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাবি। মহম্মদ শাহ রাজি হলেন। ইতিমধ্যে সরফরাজের ছাঁটাই করা সৈন্যরা গোপনে যোগ দিলেন আলিবর্দীর সৈন্যবাহিনীতে। আলিবর্দী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন নবাব সরফরাজের বিরুদ্ধে। দূত মাধ্যমে খবর পৌঁছোল নবাবের কাছে। স্তম্ভিত সরফরাজ বাধ্য হয়ে আলিবর্দীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা স্থির করলেন। ভাগিরথীর তীরে গিরিয়া নামক স্থানে দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনী মুখোমুখি হল। দুই পক্ষের দূতের মাধ্যমেও সন্ধির চেষ্টা ব্যর্থ হল। তিনদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হল সরফরাজের সৈন্যদলকে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মৃত্যু হল মুর্শিদকুলির দৌহিত্র নবাব সরফরাজের। মুর্শিদাবাদে তাঁর মৃতদেহের সমাধি দেওয়া হয়। অবসান হল মুর্শিদকুলি বংশের যুগ। আলিবর্দী বসলেন মুর্শিদাবাদের মনসদে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...