তুই কি পাগল! তোর থেকে মিনিমাম দশ বারো বছরের বড়ো হবেন। স্যার বিবাহিত কিনা তাও জানিস না। আর বিবাহিত না হলেও প্রেমিকাও থাকতে পারে! কী এমন দেখলি স্যারের মধ্যে? সোহা বলে প্রিয় বান্ধবী প্রিয়াকে।

জানি না কেন ভালো লাগে! কেন এত ভালোবাসি। স্যার হয়তো বা কোনও দিন জানতেও পারবেন না।

প্রিয়া দাস। কলেজে সেকেন্ড ইয়ার বোটানি অনার্সে যখন, তখনই জয়েন করলেন নির্মল রায় স্যার। লম্বা, শ্যামবর্ণ অতি সাধারণ মানের দেখতে স্যারকে কিন্তু মন দিয়ে বসল প্রিয়া। কেন জানে না! ভীষণ টান অনুভব করে স্যারের প্রতি। স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা। কী যে ভীষণ আকর্ষণীয় ! কী ভীষণ টানে ওকে।

প্রাক্টিক্যাল ক্লাসে ল্যাবে স্যার প্রত্যেকের কাছে এসে কাজ দেখেন। প্রিয়ার কাছে এলে ওর বুক তোলপাড় করে। অসম্ভব একটা ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়।

চোখের পলকেই যেন কেটে যায় একটা বছর। থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার সিট পড়েছে অন্য কলেজে। পরীক্ষার পর খুব মিস করতে থাকে স্যারকে, কতদিন দেখেনি। বরাবরের ভালো ছাত্রী প্রিয়ার রেজাল্টও ভালো হয়। রেজাল্ট নিয়ে ডিপার্টমেন্টে স্যার, ম্যাডামদের প্রণাম করলে সকলে আশীর্বাদ করেন। নির্মল স্যার বলে ওঠেন, আরে না না প্রণাম করতে হবে না। শোনে না প্রিয়া। প্রণাম করে। স্যারকে একটু ছোঁয়া যে কতদিনের ইচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন সুখী হও। স্বাবলম্বী হও।

ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। সেদিন অফিসে ফোনটা এসেছিল। তারপর সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিল। মাথায় জল দেয় কলিগরা। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। বাকরুদ্ধ, হতবুদ্ধি। কী করণীয়, কী করা উচিত, ভাবতে পারছিল না।

প্রিয়ার ফোনটা নিয়ে রিং ব্যাক করে কলিগ দেবরাজ। জানতে পারে সবটা। কতটা শক পেয়েছে প্রিয়া অনুধাবন করতে পারে। দেবরাজ- সহ অফিসের আরও দু’জন কলিগ মিলে প্রিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রিয়ার বাড়িতে পৌঁছোনোর আগেই বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। হসপিটাল থেকে বডি আসতে সময় লাগবে। সারা রাস্তা প্রিয়া কথা বলেনি একটাও। কান্নার আওয়াজে যেন গোটাপাড়া ভেঙে পড়েছে। আজ বেলা দশটায় যারা জীবিত ছিল। হাসিখুশিতে কলকল করছিল। বিকালে তারা ফিরে এল শববাহী দুটো গাড়িতে। কোন মা এটা সহ্য করতে পারে! কোন বোন মেনে নিতে পারে তার প্রিয় দাদা বউদির এমন আকস্মিক মৃত্যু। তিন বছরের শিশুকন্যাকে রেখে লরির ধাক্কায় প্রাণ দিল ওরা। বাজারে বেরিয়েছিল ফিরে এসে দুপুরে ভাত খাবে বলে গিয়েছিল।

এরপরে জীবনটা বদলে গেল প্রিয়ার। তার মাথায় তিন বছরের শিশুকন্যা সুকন্যার দায়দায়িত্ব এসে পড়ল। সুকন্যার জগতে ঠাম্মা আর পিসি। মা ছাড়া বেশ কিছুদিন খুব কেঁদেছিল সুকন্যা। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে গেল। প্রিয়াই ওর মা হয়ে ওঠে। প্রিয়ার জগৎ সুকন্যাকে ঘিরেই।

সুকন্যার এখন বয়স দশ। শহরে নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। সুকন্যার স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন আছে। পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমন ভালো গান গায়। প্রিয়া নিজে গান শিখিয়েছে। দুর্দান্ত গানের গলা ছিল দাদার। সুকন্যা বাবার গুণ পেয়েছে। সুকন্যা আর গান এই দুটোই এখন প্রিয়ার বাঁচার অবলম্বন। গানই ওর মন ভালো রাখে। বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। অফিসে যখন কাজ করে তখনও ওর মোবাইলে খুব আস্তে রবীন্দ্র সংগীত বাজে। মন ভালো থাকে।

(ক্রমশঃ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...