বর্তমানে নারীশক্তির চারিদিকে জয়জয়কার তুঙ্গে। সময়ের সাথে সাথে নারীদের ভূমিকাও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। মহিলারা ঘরের বাইরে পা রেখেছেন এবং নিজেদের জন্য একটি বড়ো পরিচয় তৈরি করেছেন। তাদের একটি বিশেষত্ব হ’ল বেশিরভাগ মহিলারাই মাল্টিটাস্কিং করতে অভ্যস্ত, যারা নিজেদের পরিচালনার মাধ্যমে নিজের কাজগুলি খুব ভালো ভাবে সম্পাদন করছেন। আজ, প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলারা তাদের কাজে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। কিন্তু লিঙ্গবৈষম্যের শিকড় আজও আমাদের সমাজের মানসিকতার মধ্যে থেকে গেছে।
আজ আমরা আলোচনা করছি Working Woman-দের নিয়ে, যাদের ওপর দায়িত্বের বোঝা আজ দ্বিগুন নয় বরং আর এক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। অফিস থেকে উপার্জন করুন, বাড়ি চালান, স্ত্রীয়ের কর্তব্য ও সন্তানধর্ম পালন করুন সঙ্গে বাচ্চাদের মধ্যে মূল্যবোধও গড়ে তুলুন। শুধু তাই নয়, সমান উদ্যমে এর উপর নিষ্ঠাভরে পূজাপাঠ ও আচার-অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করুন। এটা কি সত্যি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়?
মহিলারা সারাদিন অমানবিক পরিশ্রম করার পর কিছু মুহূর্তের জন্য আরামের আকাঙ্ক্ষা রাখতেই পারেন। কিন্তু দায়বদ্ধতা তাদের শান্তিপূর্ণভাবে দিনযাপন করতে দেয় না। যদিও সংবিধান নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছ। অথচ আমাদের সমাজে কুসংস্কার এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকড় এতটাই গভীর যে, নারীরা চেষ্টা করেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। পরিবর্তনই সমাজের নিয়ম, কিন্তু এই নিয়ম কি শুধু নারীদের জন্যই প্রযোজ্য হবে? এই সমাজ কি পুরুষদের নিয়েও গঠিত নয? শুধুই কি নারীদের নিয়ে গঠিত?
নিম্ন মানসিকতার শিকার
বর্তমানে ৫৮ শতাংশ নারী Working Women। নারীরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিচ্ছে, কিন্তু তাদের জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ এবং তাদের দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ শেষ হওয়ার নামই নেয় না। পরিবারের দেখাশোনা, রান্নাবান্না, বাচ্চাদের স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা, স্বামীর জন্য টিফিন তৈরি করা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে তাদের উঠতে হয়। এসব কাজ শেষ করে তারা অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তারা যদি কাজের জন্য একজন সহায়ক নিয়োগ করে তবে তাদের নিজেদেরই তার সমস্ত দায়িত্বভার বহন করতে হয় যেমন সে ঠিকমতো বাড়ির কাজ করছে কিনা খেয়াল রাখা, ঠিক সময়ে আসছে কিনা, এমনকি তার মাসমাইনের দায়িত্বও বহন করতে হয়। সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ের জন্য, কর্মরত মহিলারা চেষ্টা করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বাড়ির কাজের সঙ্গে জুড়ে রাখতে। পরিবারের পাশাপাশি কর্মরতাদের তাদের অফিসেও, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বৈত মানসিকতার মুখোমুখি হতে হয়।
ডিম্পল একজন Working Woman। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ডিম্পল নিজের বাড়ি থেকেই তাঁর কাজ সম্পাদন করেন। তিনি একটি ওষুধের দোকান চালান, পরিবার এবং কাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে তিনি সফল। কিন্তু সমাজের নীচ মানসিকতা ডিম্পলকেও নিজের শিকার বানাতে জল্পনা চালায়। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে প্রতিবেশীরা তাঁর এই সাফল্য সহ্য করতে পারে না। তাঁর প্রতি মন্তব্য করা হয় যে, ডিম্পল-এর পূজাপাঠ করা উচিত, নির্জলা উপবাস রাখা উচিত এবং বাড়ির সদস্যদের জন্য সুস্বাদু খাবারও তৈরি করা উচিত। এটাই নারীর একমাত্র ধর্ম। সব ধর্মই কি তাহলে নারীর ধর্ম?
জরিপ যা বলছে
একটি জরিপে, পুরুষ কর্মচারীরা মতামত দিয়েছিল যে, ‘মহিলারা মহিলা হওয়ার সুবিধা নেয় যেমন – আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। সরকারি চাকরিতে নারীদের ছাড় দিয়েছে সরকার। এখানে সবাই চাকরি করতে এসেছে তাহলে মহিলারা বিশেষ সুবিধা কেন পাবে? আমরা যখন ছোটো ছোটো গ্রামগুলিতে স্থানান্তরিত হই, তখন কেন তাদের জন্য একই নিয়ম লাগু নয়?’
তারপর তাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে তারা কি বাড়িতে গিয়ে তাদের স্ত্রীদের সাহায্য করে, কারণ তাদের স্ত্রীরাও Working Women? উত্তর ছিল যে, ‘আমরা স্ত্রীকে বলিনি যে বাইরে গিয়ে চাকরি করতে, তারা নিজেদের ইচ্ছে বা পছন্দে চাকরি করছে বলতে পারেন। আমরা বাড়ির জন্য উপার্জন করি, সংসারের খরচ চালাই, বাড়ির কাজের জন্য একজন গৃহপরিচারিকা রেখে দিয়েছি। আমরা কেন বাড়ির কাজ করব?
অধিকারের বিভাজন রেখা
অধিকারের বিভাজন রেখাকে কে বা কারা সমাজের বুকে আরও গভীরতর করেছে? কেন কোনও পুরুষ গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করতে লজ্জা পায়? যদিও সমাজে ১০শতাংশ মানুষ রয়েছে যারা প্রকাশ্যে তাদের স্ত্রীদের গৃহকর্মে সাহায্য করে, কিন্তু এই সংখ্যা নগণ্য। এ ধরনের লোকদের সমাজ ‘বউয়ের কথায় ওঠে বসে’ বলে চিহ্নিত করে।
অঙ্কিতা নিজে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি উঁচু পদে কাজ করেন এবং তাঁর স্বামীও একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। অঙ্কিতা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের ওষুধ, বাচ্চাদের টিফিন তৈরি করে ১০টায় অফিসে যান। এমনকী বাড়িতে যে-কোনও পূজা-অনুষ্ঠানে তিনি একাই বাজার করা থেকে পূজার সব আয়োজন একাই সামলান। সন্তানদের জন্মদিনে পুরোহিত ডেকে বাড়িতেই বিশেষ পূজার আয়োজন করেন। পরিবারের প্রতিটি দায়িত্বের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্বও তিনিই বহন করেন। রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন, কিন্তু পরের দিনের দুশ্চিন্তা অঙ্কিতার ঘুমে ব্যঘাত ঘটায়। কিন্তু সকালে উঠে প্রতিদিনই এই রুটিনের হেরফের হতে দেন না। অঙ্কিতার মতো এই পরিস্থিতি বর্তমানে শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও জায়গা করে নিয়েছে।
একা কীভাবে সব সামলান অঙ্কিতাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো আমাদের সংস্কার এবং মূল্যবোধ। আমরা যদি আমাদের সন্তান এবং প্রিয়জনদের জন্য এটুকু না করি তবে কে করবে? পরিবারের প্রতি এটা আমার সত্যিকারের ভক্তি ও ভালোবাসা, যা পুরো পরিবারকে খুশিতে রেখেছে।’