পর্ব-২

এরপর দুজনের মেলামেশা, ঘোরাফেরা। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত। অন্বেষার বাবার, এই বিয়েতে একদমই মত ছিল না। দুজনের পীড়াপীড়িতে যখন মেশোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম ওনার বাড়িতে, উনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘দ্যাখো ভানু, তোমার বন্ধুকে তোমার ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মতো অতটাও ম্যাচিওর হয়নি অনু। তাছাড়া খবর নিয়ে দেখলাম, তোমার বন্ধুটির তো নিয়মিতই বার-এ বসার অভ্যেস। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তো আর মেয়েটাকে জলে ফেলে দিতে পারি না।’

প্রত্যুত্তরে বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘দেখুন দু-এক পেগ মদ্যপান করলে কেউ খারাপ হয়ে যায় না। আজকাল কাজের ক্ষেত্রে এসব একটু-আধটু খেতেই হয়। তাছাড়া ওরা দুজন-দুজনকে জানে ও ভালোবাসে। আপনি মত দিলেও ওরা বিয়ে করবে, না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ…। কাজেই এবার আপনি বুঝুন কী করবেন। মেয়ে আপনার কাছে চিরদিন ছোটোই থাকবে, আফটার অল আইনের চোখে ওরা তো অ্যাডাল্ট এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নিজেরা ডিসিশন নেওয়ার অধিকারী।’

অগত্যা… অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হল। সম্মতিক্রমে বিয়েটাও হয়ে গেল।

বিয়ের কয়েকদিন পরেই শুভজিতের আসল চেহারাটা ধরা পড়ে অন্বেষার কাছে। একদিন নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি, অন্বেষা ঢুকল। কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে কখন এলি? বাঁদরটা কোথায়?’

“তার কথা আর বোলো না। যা কাণ্ডটা বাধাল কাল। শুধু মামা অসুস্থ, না এলেই নয় তাই বাধ্য…।’

রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন রে কী হয়েছে?’

‘কাল রাত ১টা নাগাদ খবরের কাগজের সম্পাদক বিকাশবাবুর ফোন। জানাল রিজিওনাল বিজনেস পার্ক উদ্‌ঘাটন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য পাঠিয়েছিল শুভকে। কিন্তু রাত ১টা নাগাদও অফিসে কোনও ছবি পাঠায়নি শুভ। তাঁর হাউসের তো একটা রেপুটেশন আছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ খবর যদি ছাপা না হয়, তো কম্পিটিশনের বাজারে তাঁর টিকে থাকাই দায় হবে।’

উত্তরে শুধু তখন ওর বাড়িতে না ফেরার কথাটা বলতে পেরেছিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে কাগজের রেপুটেশন-এর প্রশ্ন, সেখানে শুভর চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি হতে পারে। চিন্তায় সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’

‘তারপর। তারপর কী হল?’ বলে উঠলাম।

‘ফোনের পর ফোন করে গেছি ভানুদা। সমানে নট রিচেবল আসছিল।। ভাবছিলাম অন্য কিছু।’

বললাম, ‘আমাকে ফোন করলি না কেন?’

‘তোমাকে ফোন করার জন্যই ফোনটা সবে হাতে নিয়েছি, ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠল। রাত তখন আড়াইটে হবে। বাবু ফিরলেন। বেহেড অবস্থা।’

অফিসে ছবি না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলল, অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেখানেই ক্যামেরা পড়ে গিয়ে সিস্টেমে গণ্ডগোল। আসল সত্যিটা হল, ও অনুষ্ঠানে যায়ইনি। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সারারাত নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল কোথাও।’ বলার পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ কানে এল। চোখদুটোও ছলছল করছে অন্বেষার ।

পরের প্রশ্নটা কী হতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি। যা ভাবা ঠিক তাই, খানিক থামার পর প্রশ্ন করল, ‘ও কি আগাগোড়াই এমনই ছিল ভানুদা?’

বোবার মতো চেয়ে থাকলাম ওর দিকে। কে যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছে আমাকে।

এমন নয় যে, এই প্রথমবার শুনলাম শুভ নেশার জন্য কোনও কাজ করেনি। একবার আমার এক বন্ধুর বাবার বার্ষিকীর কাজে ছবি দরকার। সেইজন্য দায়িত্ব নিয়ে ছয় বাই ছয় সাইজের ল্যামিনেটেড ছবি বানাতে দিয়েছিলাম শুভকে। কথা ছিল পরের দিনই ডেলিভারি দেবে।

রাত্তিরে যখন ওর বাড়িতে গেলাম, দরজায় তখন তালা ঝোলানো। দু-দিন পরে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, রীতিমতো রাগারাগি। ‘তুই যখন সময় মতো দিতেই পারবি না, পরিষ্কার বলে দিতিস। তোর জন্য কতটা লজ্জিত হতে হল আমাকে।’

শুভ তখন কেমন সহজভাবে বলে ফেলল, “ইয়ার ছবির কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রেস ফোটোগ্রাফারদের একটা পার্টি ছিল। ওখানেই একটু বেশি চড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আর কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বরং একটা সরি জানিয়ে দিস।’

কোনও সদুত্তর না পেয়ে অন্বেষা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল ভানুদা, কই কিছু বললে না তো!

‘অ্যাঁ, অ্যা কী যেন বলছিলিস?’

‘ওই-ই শুভর নেশা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ দ্যাখ, ওর যে আগেও দু-এক পেগ চলত এটা তো তুইও জানতিস। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে চলে গেছে, সেটা আমারও অজানা।’

‘বাবা জানলে কী যে হবে কে জানে!’

ওর টেনশন দেখে বললাম, ‘দ্যাখ অন্বেষা এখন ওসব ছাড়। আমার মনে হয়, যা হয়েছে ভুলে যা। তুইও ওকে একটু সময় দে। কদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুজন মিলে কোথাও ঘুরে আয়। ওকে বোঝা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...