কিন্নর কৈলাস ও স্পিতি নদী ডাক পাঠিয়েছিল বারেবারে কিন্তু প্রতিবারই বিভিন্ন কারণে সফর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। এইবারের মসৃণ প্ল্যানেও শেষমুহূর্তের চরম বিভ্রাট উপস্থিত হলেও তাকে বাউন্সার দিয়ে ভাগিয়ে ফুল টিমের সাথে মিলে গেলাম সিমলা ম্যালে।

পরদিন ভোর বেলা আমাদের ১২ জনের টিম তিনটি গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম ১৮৫ কিমি পথ, সারাহানপুরের ভীমাকালী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে। মন্দিরে পুজো দিয়ে অপূর্ব বর্ণাঢ্য রঙিন রামদানা খেতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা সাংলাভ্যালি ও ছিটকুলের অপার রহস্যের হাতছানিতে বিভোর হয়ে ঢুকে পড়ি কল্পার অন্দরমহলে। ৯৫০০ ফিট হাইটে কল্পার বুকে দাঁড়িয়ে কিন্নর কৈলাস পিক দর্শন যেন দেব দর্শনই বটে। ৭৯ ফুট উঁচু ঠিক শিবলিঙ্গের প্রস্তরখণ্ডকে স্থানীয়রা শিব জ্ঞানে পুজো করেন। কথিত আছে শিব ভক্ত বাণাসুর এই লিঙ্গটি স্থাপন করেন। বরফাবৃত সমস্ত চরাচরে সূর্যাস্তের কমলা রং যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা আত্মহারা প্রকৃতির এহেন রূপ দেখে।

পাহাড়ি হাঁটাপথে দেখি পাইনের সারি, সোনালি আপেল বাগান, অপূর্ব সুন্দর স্থানীয় কিন্নরীরা আপেলের মতো টুসটুসে গাল নিয়ে চলছে ফিরছে গল্প করছে। পাইন গাছের মাথার ওপর দিয়ে ঝুঁকেপড়া কোজাগরি চন্দ্রজ্যোতি চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিল। কোজাগরি চাঁদ আজ জাগবে সারারাত পৃথিবীর ছায়াপথে। কল্পার অসাধারণ রূপ আমাদের মোহিত করলেও বাকরোধ হলাম কল্পার পরবর্তী হিমালয়ান পৌরুষ দেখে। কারণ এর পরের যাত্রাপথেই হিমালয় অন্য ক্যানভাস আঁকতে শুরু করে। সিমলা, কুলু-মানালি ট্রিপ যেভাবে বাঙালির ভ্রমণযাপনে ক্রেজ তৈরি করেছিল, হিমাচলের অন্তিম পশ্চিম প্রান্তর বৃষ্টিহীন, প্রচন্ড ঠান্ডা, অনুন্নত, ধূসর বরফাবৃত মরু প্রান্তর হিসেবে কিছুটা ব্রাত্যই থেকে গেছে। পরবর্তীকালে মানে বর্তমানে গ্লোবালাইজেশনের যুগে ভ্রমণে ফোটোগ্রাফির মারাত্মক চাহিদা হিমাচলের পশ্চিম প্রান্তরকে প্রজাপতির মতো ঝলমলে করে তুলেছে।

কল্পা থেকে রেকংপিও হয়ে আমরা নাকো লেকের দিকে অগ্রসর হই। খাব নামের জায়গাটিতে ঘোলা জলের শতদ্রু এবং নীলাভ স্পিতির সঙ্গম ঘটেছে। এই দুই নদীর সঙ্গম অর্থাৎ একে অপরকে কাছে টানার গল্প যতটাই উজ্জ্বল ঠিক ততটাই ভয়ংকর। রাস্তাও যেন ক্রমশ হামাগুড়ি দিয়ে নদীর কোলের কাছে নেমে গেছে। সঙ্গমের গা ঘেঁষেই দৈত্যাকৃতির পর্বত পাশ থেকে ঝুঁকে নদীকে পাহারা দিয়ে রেখেছে একফালি আকাশ বুকে করে। খাব ব্রিজের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড চড়াই পথ অতিক্রম করে কিন্নর প্রদেশের শেষ প্রান্তে ২,৯০০ মিটার উচ্চতায় নাকো লেক। রুক্ষ পর্বতমালা বেষ্টিত ধূসর প্রকৃতির কোলে নীলাঞ্জন ঘন পুঞ্জছায়ায় বসে আছে পান্না সবুজ নাকো লেক।

লিওপার্গিল শৃঙ্গ-সহ তুষারাবৃত গিরি শ্রেণি নিয়ে উইলো, পপলার গাছের সোনালি পাতায় ছাওয়া চ্যাপ্‌টা শ্লেট পাথরের তৈরি শ’খানেক ঘরবাড়ি নিয়েই নাকো লেক। যা মনে জলতরঙ্গের মতো টোকা দেয়। গাঢ় নীলবুনট আকাশের প্রেক্ষাপটে অন্য এক হিমালয় খোলাপাতার মতো ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হচ্ছে আর ফ্ল্যাট ব্রাশ দিয়ে আমি প্রকৃতির দেয়ালে এঁকে রাখছি আমার প্রতিবিম্ব নিরুচ্চারে ঘোষণা করছি আমি হিমালয়প্রেমী। উজ্জ্বল শরতের দুপুরে গাড়ির পেছনের উইন্ডোফ্রেমে তাকিয়ে দেখি উদ্ভাসিত সূর্যের আলোয় নাকো লেক ঝিলমিল করছে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...