সিন্দুকের কী-হোলের চারপাশে চাবি ঘষার দাগ থেকে আন্দাজ করা যায়, যিনি চাবিটি ব্যবহার করেছেন তিনি অনভিজ্ঞ। সিন্দুকের চাবি কোথায় রাখা থাকে সেকথা সাধন বিলক্ষণ জানত, শুধু জানত না ঠিক কোন চাবিটা তার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সিন্দুকের হাতলটিতে নস্যির গুঁড়ো লক্ষ্য করেছিলাম। ওই বাড়িতে নস্যি নেওয়ার অভ্যাস যে একমাত্র সাধন পান্ডেরই আছে সেটা আশাকরি তুমি মনে করতে পারছ?

শেষের প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে করল কমলাক্ষ। তৎক্ষণাৎ প্রথম দিনের স্মৃতিটা তাজা হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসাবাদ করতে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই কোনও একটা পিঁড়ির উপর বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল সাধনকে। বয়স এবং দুঃখের মিশেলে মুখটা হয়ে উঠেছিল বেজায় ফ্যাকাশে। তার হাতে ছোট্ট স্টিলের নস্যির কৌটা তখনই নজরে পড়েছিল বটে।

—মূল্যবান পাথরগুলো রাতারাতি সরিয়ে ফেলা সাধনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কমলাক্ষ পুনরায় বলতে শুরু করল, তাই সে বুদ্ধিকরে ওইগুলোকে অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ফেলে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য রঙিন পাথরের সাথে সেগুলি দিব্বি আত্মগোপন করে যায়, এতদূর বলে কমলাক্ষ একটু বিরাম নিল।

—সে না হয় বুঝলাম। ইন্সপেক্টর মল্লিক বললেন, কিন্তু ওই ইউকোলেলের স্ট্রিং খুলেই যে হত্যার কাজটি করা হয়েছে তা কী করে বুঝলেন?

— ইউকোলেলে! মানে যেটা মনোময়বাবুর দেয়ালে টাঙানো ছিল? প্রশ্নটা এবার আমি করলাম।

—একদম ঠিক বলেছ বিনয়। কাল রাতে ফোনে পোস্টমর্টেমের রিপোর্টের বক্তব্যটা শোনামাত্রই ব্যাপারটা মাথায় আসে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, খুব সরু কিছু দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘরে সবচেয়ে সহজলভ্য অস্ত্রটি ছিল ইউকোলেলের তার। এখানে মনে রাখতে হবে সাধন কিন্তু গ্রামের মানুষ। একতারার মতো বাদ্যযন্ত্র সম্বন্ধে তার জ্ঞান থাকাটা মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু হায়, এই রন্ধনশিল্পী ইউকোলেলের তারের বন্ধনশৈলীটি আত্মস্থ করতে পারেনি।

—সে ক্ষেত্রে মধুলতাদেবীও নিশ্চয়ই সন্দেহের তালিকায় ছিল? প্রশ্নটি করলেন ইন্সপেক্টর মল্লিক।

—তা তো বটেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে দুটি সমস্যা আছে, প্রথমত- খুনি তারটি খুলেছে বটে কিন্তু পরিপাটি করে সেটিকে পূর্বরূপে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। অর্থাৎ আবার সেই অপরিপক্ক হাতের কাজ! দ্বিতীয়ত- ওই ইউকোলেলেটি ছিল দেয়ালে টাঙানো একটি শোপিস হিসেবে এবং সেটি বোঝা যায় তার উপর জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ দেখে। সেই ধুলোর উপর যে-আঙুলের ছাপগুলো পাওয়া গেছে তা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, খুনির বাঁ হাতের আঙুল যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে মধ্যমার কোনও ছাপ পড়েনি, অর্থাৎ…

—মনে পড়েছে, গতকাল সাধনের সাথে কথা বলার সময় খেয়াল করেছিলাম ওর বাঁহাতের মধ্যমা আঙুলটা নেই। মনে মনে কমলাক্ষের উদ্দেশ্যে বললাম, সাব্বাস, তোমার চোখ বটে!

—ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আর সময় ব্যয় হয়নি। তবে আরও একটি ব্যাপার হল, যদি মধুলতাদেবী বা অখিলেশ চুরিটা করতেন, তাহলে পাথরগুলিকে কখনওই অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ফেলে রাখতেন না, চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে কমলাক্ষ উপসংহার টানল।

—সত্যিই আপনার জবাব নেই কমলাক্ষবাবু, ইন্সপেক্টর মল্লিক বললেন।

গত সাত বছর কমলাক্ষ আমার পরম বন্ধু। তার প্রত্যেকটি সফলতার পর ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না। মনে মনে আমার বন্ধুটির মগজকে কুর্নিশ জানালাম।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...