আজ পাঠকদের একটা জায়গার গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে। সেই সুন্দর জায়গাটার চারপাশেই পাহাড়। সেখানে জঙ্গল আছে সেইসঙ্গে একটি সুন্দর লেকও আছে। সমুদ্রতল থেকে জায়গাটা কতটা উঁচুতে? বেশি নয়, মাত্র ৮০৩ মিটার বা ২৬২৫ ফুট। মুম্বই থেকে দূরত্ব ? তাও বেশি নয়, মাত্র ৮৩ কিমি। এবার বোধ হয় বোঝা যাচ্ছে জায়গাটার নাম কী? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন— জায়গাটার নাম মাথেরান।
কী করে যেতে হয় সেখানে? সেটাও খুব সহজ ব্যাপার। মুম্বই থেকে ট্রেনে চেপে নেরালে এসে, ন্যারোগেজ লাইনের টয় ট্রেন চড়ে মাথেরানে আসা যায়। আবার ওই জায়গা থেকে সড়ক পথে নিজের গাড়ি বা ট্যাক্সিতেও আসা যায় মাথেরানে। নেরাল থেকে টয় ট্রেনে চড়ার ছোট্ট স্টেশনটি হল ‘আমন লজ’— বেশ মজার নাম!
আমরা শনিবারের সকালে মাথেরানের উদ্দেশ্যে বার হয়েছি থানে থেকে, দূরত্ব ৬৮ কিমি। যাত্রার প্ল্যানটা এবার একটু অন্যরকম। মাজিওয়াড়ায় রুস্তমজি আরবানিয়া-র অ্যাজিয়ানো টাওয়ার থেকে অটোয় চেপে চলে এলাম জুম কার রেন্টাল সেন্টার-এ। অনলাইনে আগেই বুক করা ছিল একটি হুন্ডাই অ্যাক্সেন্ট। গাড়ি পেতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল। এক বন্ধু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। আমরা পামবিচ রোড ধরে চলে এলাম বেলাপুর-এ। কিছুক্ষণ পরেই সিল-ফাটা রোড ধরে পৌঁছে গেলাম মুম্বরা ভ্যালিতে। কল্যাণ-সিল রোড ধরে গাড়ি ছুটছে। পূর্ব ডোম্বিওলি থেকে গাড়ি ডানদিকে বাঁক নিল।
বহু দিনের ইচ্ছে আজ পূর্ণ হতে চলেছে, তাই মনে বেশ আনন্দ। পালাভা পেরিয়ে নায়ারা-তে পৌঁছোলাম। গাড়ি একটু পরেই পূর্ব বাদলাপুর পেরিয়ে কার্জটি রোডে চলে এল। অম্বরনাথ পেরোতেই রাস্তার দুই পাশে শুষ্ক, পর্ণমোচী বৃক্ষের হালকা সমাবেশ। ভুল করে নেরাল যাবার রাস্তা ছাড়িয়ে সোজা কার্জাটের পথে অনেক দূর চলে এসেছিলাম। ভুল ভাঙতেই গাড়ি ঘোরানো হল।
৪-৫ কিমি রাস্তা ফিরে আসার পরে হঠাৎই গাড়ির গণ্ডগোল শুরু হল এবং কিছু দূর এগিয়ে সেটা থেমেই গেল। গাড়ি স্টার্ট করা গেলেও ঢাকা আর ঘোরে না। শুরু হল মেকানিকের খোঁজ। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কী করে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে মাথেরানে। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে এক মেকানিক ও তার হেল্পার এসে গাড়ি চেক করে জানাল, গাড়ির ক্লাচ প্লেট জ্বলে গেছে। সেটা পালটাতে খরচ পড়বে প্রায় ১২ হাজার টাকা এবং সময়সাপেক্ষ। দ্রুত যোগাযোগ করা হল জুম কার-এর অফিসে। সঙ্গের মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতার কারণে এবং পুলিশের ভয় দেখিয়ে জুম কার-এর ভারপ্রাপ্ত এক অফিসারকে রাজি করানো গেল শর্ত সাপেক্ষে। আমরা গাড়ির চাবি ভিতরে রেখে গাড়ি বন্ধ করে দিলাম। গাড়ি কোথায় পার্ক করা আছে তা আগেই জানানো হয়েছিল।
অনাহূত ঝামেলায় ইতিমধ্যেই এক ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে। ১০ কিমি দূরত্বে মাথেরান যাবার ট্যাক্সি এল আরও ১৫ মিনিট পরে। সেই গাড়িতে চড়ে বাঁ দিকে নেরাল হয়ে মাথেরানের রাস্তায় আসতেই আমরা খুশি হয়ে উঠলাম। শুরু থেকেই চড়াই রাস্তা পাহাড়কে পাক দিয়ে ওপরে উঠেছে। দুপুরবেলায় রোদের তেজ যথেষ্ট। তবে মাঝে মাঝে হাওয়া বইছিল।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পর্ণমোচী বৃক্ষকুলের মাঝে চিরহরিৎ গাছগুলি চোখের আরাম জোগাচ্ছিল। দুপুর ১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মাথেরানের কার স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে মূল মাথেরানের হোটেলে পৌঁছোতে হবে ঘোড়ার পিঠে চড়ে। ঘোড়া পিছু ৬৫০ টাকা দরে ৪টি ঘোড়া এবং মাল বওয়ার জন্য আরও ৩০০ টাকায় একজন কুলি নেওয়া হল সঙ্গে। বুঝতে পারলাম, শৈলশহর হিসেবে মাথেরান যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
আমাদের মতো আরও কিছু পর্যটক ঘোড়ায় চেপে চলেছেন তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলগুলিতে। রাস্তার চড়াই ভয়ংকর নয় কিন্তু অনভিজ্ঞ ও ক্লান্ত পর্যটকদের কাছে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়াটা দরকারি। কিছুদূর এগোতেই রাস্তার দু’পাশে প্রাচীন ও নবীন চিরহরিৎ বৃক্ষের জঙ্গল মন ভরিয়ে দিল ভালোলাগায়। চড়াই পথে আড়াই-তিন কিমি দূরত্ব পেরিয়ে হোটেলে পৌঁছোতে আধ ঘণ্টা লেগে গেল।
(চলবে)