চলচ্চিত্র উৎসবে বিদেশি ছবি দেখতেই মূলত বেশি আগ্রহী থাকেন সিনেমাপ্রেমীরা। কারণ, বড়োপর্দার সামনে বসে উৎসবের আবহে একগুচ্ছ বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যায় একমাত্র এই চলচ্চিত্র উৎসবেই। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের শুরু থেকেই বিদেশি ছবির পাশাপাশি বাংলা ছবি দেখার জন্যও ছিল বাড়তি উন্মাদনা। বিশেষকরে বাঙালি দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে দিয়েছিলেন বলা যায়। অবশ্য শুধু বাংলা ছবির দর্শকরাই নন, বলিউডের পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপও অঞ্জন দত্ত-র ছবি ‘চালচিত্র এখন’ দেখার আগ্রহে, তাঁরজন্য নির্ধারিত প্রেস কনফারেন্সও অনুরোধ করে পিছিয়ে দিয়েছিলেন। এমনই ছিল এবার বাংলা ছবি দেখার আগ্রহ।
২০২৩-এর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত মোট ২১৯টি ছবির মধ্যে প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল ৭২টি বড়ো ছবি। এরমধ্যে ‘বেঙ্গলি প্যানোরমা বিভাগ’-এ ছিল মোট ৭টি ছবি। যাইহোক, নন্দন সহ মোট ২৩টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছে এই ছবিগুলি। অধিকাংশ শো-এ দর্শক আসন ছিল কানায়-কানায় পূর্ণ। উৎসবের অষ্টম দিনে অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর সন্ধেবেলা বিজয়ী ছবিগুলিকে পুরস্কার প্রদান করা হয় রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে। এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বলিউড অভিনেত্রী অদিতি রাও হায়দরি। সেইসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, পরিচালক সুধীর মিশ্র, গৌতম ঘোষ এবং কয়েকজন বিদেশি পরিচালক।
‘ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ’ বিভাগে সেরা ছবির শিরোপা পায় ইজরায়েলের ছবি ‘চিলড্রেন অফ নোবডি’। মানবিক মুল্যবোধের বিষয় নির্ভর এই ছবিটির পরিচালক ইরেজ ট্যাডমোর। পরিচালক পুরস্কার নিতে মঞ্চে উপস্থিত থাকতে না পারলেও, তাঁর ছবির জন্য ৫১ লক্ষ টাকা পুরস্কার মূল্য ছাড়াও বরাদ্দ ছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার গোল্ডেন ট্রফি। বিজয়ী ছবি ‘চিলড্রেন অফ নোবডি’-ই ছিল ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ক্লোজিং ফিল্ম। এই ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে নন্দন এক প্রেক্ষাগৃহে ১২ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে সাতটায়।
অঞ্জন দত্ত-র ছবি ‘চালচিত্র এখন’ ছিল ওই একই বিভাগে, অর্থাৎ ‘ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ’-এ। মৃণাল সেন-এর সঙ্গে অঞ্জন দত্ত তাঁর কাজের অভিজ্ঞতাই মূলত কাহিনি আকারে তুলে ধরেছেন ‘চালচিত্র এখন’ ছবিটির মাধ্যমে। এরই পাশাপাশি অবশ্য ছবির নায়কের কলকাতার প্রতি অনীহা এবং শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার দিকটিও অনেকটা প্রাধান্য পেয়েছে এই ছবিতে। মৃণাল সেন-এর শতবর্ষ উপলক্ষ্যে এই ছবিটিও প্রদর্শিত হয়েছে নন্দন এক প্রেক্ষাগৃহে। ছবি শুরুর আগে প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি দর্শক দেখে বিষ্ময়ে আবেগল্পুত হয়ে অঞ্জন বলেছেন, ‘মৃণালদা’ বেঁচে থাকলে হয়তো খুব খুশি হতেন। শুধু তাই নয়, হয়তো তাঁর ছবি দেখার জন্যও এত ভিড় হতো না।’ যাইহোক, এবার অঞ্জনের ‘চালচিত্র এখন’ পেল স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কার মূল্য ছিল ২১ লক্ষ টাকা। ওই একই বিভাগে ভেনেজুয়েলার পরিচালক কার্লোস ড্যানিয়েল মালাভে-র ছবি ‘ওয়ান ওয়ে’ও পেয়েছে পুরস্কার।
এবার ‘বেঙ্গলি প্যানোরমা’ বিভাগে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল মোট সাতটি ছবি। সেই ছবিগুলির মধ্যে সেরা ছবি হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছে রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি-র ছবি ‘মনপতঙ্গ’। কিছুদিন আগে এই পরিচালক জুটি-ই তাঁদের ‘কালকক্ষ’ ছবির জন্য জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার। এবার ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মনপতঙ্গ’ জিতে নিল সাড়ে সাত লক্ষ টাকা-র পুরস্কার এবং ট্রফি। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রান্তিক যুবক-যুবতির ভালোবাসার জন্য লড়াইয়ের বিষয়টি এক মর্মস্পর্শী রূপ পেয়েছে এই ছবিটিতে।
‘বেঙ্গলি প্যানোরমা’ বিভাগে এবার স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সাইকোলজিক্যাল ড্রামা ফিল্ম ‘অসম্পূর্ণ’। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে এক পাঁচ বছর বয়সি সন্তানের বেড়ে ওঠার মর্মস্পর্শী দিকটিও প্রাধান্য পেয়েছে এই ছবির কাহিনিতে। এই ছবিটির পরিচালক অমর্ত্য সিনহা। তাঁর ঝুলিতেও পুরস্কার মূল্য হিসাবে পড়েছে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা। অবশ্য এই ছবিগুলি ছাড়াও আরও অনেকগুলি ছবি বিভিন্ন বিভাগে জিতে নিয়েছে পুরস্কার। যেমন এশিয়ান সিলেক্ট বিভাগে নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মায়ানমার-এর ছবি ‘ব্রোকেন ড্রিমস স্টোরিজ ফ্রম দ্য মায়ানমার কুপ’। ছবিটির পরিচালক নিনোফোল্ড মোজায়েক।
‘ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম’ বিভাগে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে হাওবাম পবন কুমার পরিচালিত ছবি ‘জোসেফ-স সন’। হীরালাল সেন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড বিভাগে রজনী বসুমাত্রে পরিচালিত ছবি ‘গোরাই ফাখরি’ পেয়েছে ১০ লক্ষ টাকার সেরা ছবি-র পুরস্কার। ওই একই বিভাগে ৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার জিতেছে সনেট অ্যান্থোনি ব্যারেটো-র ছবি ‘অবনী কী কিসমত’।
সেরা শর্ট ফিলম ‘লাস্ট রিহার্সাল’-এর জন্য ৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার ও ট্রফি জিতেছেন পরিচালক কামিল সঈফ। এছাড়া, সেরা তথ্যচিত্র হিসাবে ৩ লক্ষ টাকার পুরস্কার ও ট্রফি জিতেছে রমেন বোরা ও শিবানু বোরা পরিচালিত ‘চ্যালেঞ্জ’।