আজকাল সন্তানদের বড়ো করে তুলতে শুধু পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়— প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ অর্থেরও। একসময় পরিবারগুলিতে বাচ্চার সংখ্যা একাধিক হতো। কিন্তু এত ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না বলে, তাদের বড়ো করে তোলাটা তত ব্যয়বহুল ছিল না। ভাইবোনেদের থাকা খাওয়ার চিন্তা ছিল না ঠিকই কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তারা নিজেদেরই পরস্পরের সাহায্য নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠত। এখন মা-বাবারা সন্তানের জন্মের আগে থেকেই পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ করেন। ভারতে এখনও নানা জায়গায় মা-বাবারা আইনি চোখ রাঙানি সত্ত্বেও লিঙ্গ নির্ধারণ করে সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন।

এই পরিকল্পনা শুধু জন্ম দেওয়া পর্যন্তই ব্যপ্ত নয়, সন্তান জীবনে কী হবে, কীভাবে তার লক্ষ্যে এগোবে— তা সবই পূর্ব পরিকল্পনার ফলশ্রুতি। সন্তানের কাছে মা-বাবার চাহিদা অনেক। ভবিষ্যতে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায় যাতে, তাই তারা ‘ইনভেস্ট’ করতেও পিছপা নন। এই প্রত্যাশার চাপ কিন্তু সন্তান ও অভিভাবক দু’পক্ষেরই সমান।

এই কারণেই এত আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বা ভালো ফল হবে না এই আশঙ্কাতেও বহু ছেলেমেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। মা-বাবার স্বপ্ন সাকার করতে পারবে না এই হতাশায় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহন। আগে মা-বাবারা সন্তানকে মেধাবী করে তোলার প্রতিযোগিতায় এমন নেমে পড়তেন না। পঠনপাঠন শেষ করে দীর্ঘদিন বেকার হয়ে থাকা সন্তানকে কায়ক্লেশহীন ভাবে মেনেও নেওয়া হতো বহু পরিবারে।

আজকাল তো মনোবিদরা অনেকেই চেষ্টা করছেন মা-বাবাকে বোঝাতে, যাতে সন্তানের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ তারা সৃষ্টি না করেন নিজেদের স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশা নিয়ে। নতুন প্রজন্ম যাতে তার ইচ্ছেমতো বাঁচার পথ খুঁজতে পারে সেই স্বাধীনতা দেওয়া হোক তাদের— এই বার্তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল থ্রি ইডিয়টস ছবিটি। এমবিএ শেষ করে একটা মোটা অঙ্কের বেতন পাওয়াই জীবনের লক্ষ্য নয়, পৃথিবীতে আরও অনেক কিছুই করা যেতে পারে— এই ভাবনা অভিভাবকদের মননে কবে আসবে জানা নেই।

মা-বাবারা মনে করেন সন্তানকে মোটা অঙ্কের ফিজ দিয়ে নামজাদা স্কুলে পড়ানোর উদ্দেশ্যই হল তার একটি সুনির্দিষ্ট কেরিয়ার তৈরি করে দেওয়া। এরপর আছে এক্সট্রা-টিউটোরিয়াল, সিলেবাসের বাইরের নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করানোর চাপ।

মা-বাবাদের পুরোপুরি দোষও দেওয়া যায় না। সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক বিপুল প্রতিযোগিতার বোঝা ঠেলে তা অভিভাবক মাত্রেই চান। শুধু ভাগ্যগুণে এই সাফল্য আসে না। এর মধ্যে বিপুল পরিশ্রমও জড়িয়ে থাকে। মা-বাবাদের দোষ আরও একটি কারণে দেওয়া যাবে না, তা হল বর্তমান সময়ে কারিগরি উন্নতির ফলে সন্তানরা মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে আসক্ত। দোষ কারিগরির উন্নতিকেও দেওয়া উচিত যা ছেলেটিকে পরিশ্রম বিমুখ করে তুলছে। দোষ স্কুলের সংগঠকদেরও দেওয়া উচিত যাদের অর্থলোভের কারণে টিউটোরিয়ালগুলো রমরমিয়ে চলছে। এই যুগে যে-একনিষ্ঠতা এবং পরিশ্রম সাফল্য এনে দেয়, সেই একাগ্রতা দিয়ে বহু ছেলেমেয়েই পড়াশোনা করে না, ফলে ব্যর্থতা আসছে। যা মেনে নিতে না পেরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

সন্তানদের ভাবা উচিত মা-বাবার প্রত্যাশা বা স্বপ্ন দেখায় অন্যায় নেই। অন্যায় হচ্ছে নিজেকে ও তাদের ঠকানো। বিনা পরিশ্রমে সাফল্য আসে না। পরিশ্রম না করে পরীক্ষায় বা কেরিয়ারে অকৃতকার্য হয়ে অত্মহননে সমস্যা বাড়ে বই কমে না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...