চলার পথে মাঝে মাঝেই ধৌলিগঙ্গা চোখের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছিল। কিন্তু তার উচ্ছলতার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের কানে, মনে সারা উপত্যকা জুড়ে। এ পথে বেড়াতে গেলে দিনে দিনেই ফিরে আসতে হবে। পরিচয়পত্র জমা রাখতে হবে মালারি গ্রামের আইটিবিপি ক্যাম্পে। সারাদিন ঘুরে বিকেলে সংগ্রহ করে নিলেই হলো! যোশিমঠ থেকে মালারির দুরত্ব ৬২ কিমি। এখান থেকেই পথ দু’ভাগ হয়ে গেছে, আমরা বাঁ-দিকের পথটি ধরে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। বিবর্ণ মালারি গ্রাম ধূসর পাহাড়ের গায়ে মিশে রয়েছে গিরগিটির মতো।

পথ যত সীমানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর সবুজ ছেড়ে পাহাড়ের রং ধূসর বর্ণ ধারণ করছে। ঘোলাটে নদীর জল বদলে নীলকান্ত বর্ণ ধারণ করেছে। ধূর্ত মুখের রং বদলে যায় নিষ্পাপ সারল্যে। শরীর মনের পুনঃযৌবন ঘটাতে চাইলে থাকতে হবে মেঘেদের চাষবাস করা গামশালির সবুজ মাঠে। এখানে রাতে তারারা চুপি চুপি নেমে এসে শোনাবে মেঘ-পাহাড়ের গল্প। মাঝে মাঝে ভাল্লুক তার ছানাপনা নিয়ে হাজির হতে পারে নদীর পাড়ে। পাখির দলের সাথে পাশ দিয়ে বয়ে চলা অমৃত গঙ্গা, দিনরাত বেটোফেনের মিউজিকের মতো নিরন্তর সঙ্গ দেবে।

শান্ত নির্জন এই স্থানে সেনাবাহিনীর গাড়ির শব্দ কখনও সখনও নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে। সারল্যে ভরা গ্রামীণ মানুষগুলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে আপনার দিকে! জিজ্ঞেস করলেই বলতে শুরু করে দেবে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজীয় সব কথা। বিষেণ সিং নেগীর মতো ক্লান্ত কিষাণ, সামান্য একটা সিগারেটের বদলে সদ্য তুলে আনা মটরশুঁটি হাতে তুলে দিয়ে সারল্য ভরা হাসিতে যা ফিরিয়ে দেয় তা অমূল্য! প্রাপ্তির ঝুলি ভরে ওঠে।

রাতে তাঁবুতে থাকতে গেলে ইনার লাইন পারমিট নিতে হবে। তাঁবু ও রেশন সঙ্গে আনতে হবে। নন্দাদেবী বায়ো রিজার্ভ ফরেস্ট এবং তিব্বত সীমানার কাছে অবস্থিত হওয়ায় কারণে পারমিশন প্রয়োজন। গামশালির দেড় কিমি আগের বর্ধিষ্ণু গ্রাম বাষ্পায় চেষ্টা করলে কারও কারও বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। বাম্পায় হোম স্টে ছাড়া বর্তমানে গামশালিতে সরকারি গেস্ট হাউস তৈরি হচ্ছে। ঝঞ্ঝাট পোয়াতে পারলে সুদে-আসলে উশুল হয়ে যাবে।

গামশালি থেকে ৫ কিমি দূরে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার ইন্দো-চিন সীমানার শেষ গ্রাম নিতি। প্রাচীনকাল থেকে মানা পাসের সাথে সাড়ে ১৬ হাজার ফুট উচ্চতার নিতি পাস দিয়েও নিয়মিত চিনের সাথে বাণিজ্য চলত। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর থেকেই এই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সীমানা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিতির উচ্চতা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফুট। গামশালির উচ্চতা ১২ হাজার ফুট।

গ্রীষ্মকালে রাজমা মটরশুঁটি, অ্যাপ্রিকট ও নানা ওষধি গাছের চাষবাস হয়। আর সেইসঙ্গে কিছু পরিমাণ আপেলও হয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কুলির কাজেই এদের প্রধান জীবিকা নির্বাহ হয়। ভুটিয়া, মোর্চা সম্প্রদায়ের মূলত বাস। গাড়ওয়ালি ও তিব্বতি সম্প্রদায়ের মিশ্রণে গড়ে ওঠা সমাজের দরিদ্র্য মানুষগুলি সরকারি সুযোগ থেকে প্রায় বঞ্চিত। গরমের কয়েক মাস এখানে কাটিয়ে নীচে নেমে আসে এলাকাবাসী।

নিতির দেড় কিমি আগে রয়েছে একটি গুহা। সরল পথে হেঁটে গুহাতে পৌঁছে গেলে দেখা যাবে বেশ কয়েক ফুট লম্বা শিব লিঙ্গ। উত্তরাখণ্ড সরকার মার্চের শেষে এখানে যাওয়ার তারিখ ঘোষণা করেন। ভবিষ্যতে এই মন্দির সাধারণ পুণ্যার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হবে। অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর এই পরিবেশ।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...