বেলুড় মঠের পাশেই তাদের কলেজ ও ভেতরে হোস্টেল। তাই বিকেলে মঠে যাওয়া ইন্দ্রদের কাছে খাঁচাবন্দি বাঘের মুক্তির মতো ছিল। বেলুড়ে ভয় টিসি আর গার্জেন কলের। তবু হোস্টেল লাইফে লুকিয়ে চুরিয়ে অনেকেই সিনেমা দেখতে যেত। আগে রোগা থাকলেও হোস্টেল লাইফে শরীরে বাঁধন এসেছিল ইন্দ্রর। ফরসা, সুন্দর মুখের গড়ন, শরীরে স্মার্টনেস – এক অন্য সৌন্দর্য।
পাড়াটা ভালো, কয়েকজন কলেজ, ইউনিভর্সিটির প্রফেসরের বাড়ি এ পাড়ায়। দু’একজনের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে গেছে। মায়ের মাসির ছেলে সম্পর্কে ইন্দ্রর মামার, এ পাড়ায় খুব নাম ডাক। ডাক নাম চঞ্চল, ইন্দ্ররা চঞ্চলমামা বলে। কর্মসূত্রে টাটা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়র। ব্যবহারটা খুব ভালো। আপদে বিপদে ইন্দ্রদের পাশে থাকে। ইন্দ্রদের এ পাড়ায় জমি কেনা ও বাড়ি করার পেছনে অনেক সহযোগিতা করেছে চঞ্চলমামা।
খিদিরপুরের মতো এলাকায় জায়গা পাওয়া সহজ কথা নয়। চঞ্চলমামার এক বন্ধুর জায়গা ছিল এটা। বন্ধুদের বাড়ি আসা যাওয়া আছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের অধ্যাপক কমলকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি আর একটু গেলে। চঞ্চলমামার সঙ্গে আলাপ আছে। ইন্দ্রকে নিয়ে গেছিল এমএসসি অ্যাডমিশনের ব্যাপারে। সব নাম্বার অনুযায়ী হয়েছে। ভদ্রলোকের কিছু করার ছিল না।
ভদ্রলোকের দুটি মেয়ে। বড়োটি বাংলা অনার্স, ছোটোটি ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। ইন্দ্রকে ওই ব্যাপারে বাড়ি যাওয়ায় চিনে গেছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ইন্দ্রকে যেন কেমন করে দেখছিল ছোটোটা! দেখতে শুনতে ভালো। তবে এই মেয়ে যে ইন্দ্রকে পছন্দ করে, তা পরিষ্কার হয়েছিল নতুন বাড়িতে আসার কিছুদিন বাদেই।
বাইরের পাঁচিলটা তখনও হয়নি। পাঁচিল নিয়ে পাশের বাড়ির একটু অবজেকশন ছিল। মিউনিসিপ্যালিটিতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাঁচিল দেবার পারমিশন পেয়েছে। একদিন বিকেলে পাঁচিলটা কেমন হবে ইন্দ্র মায়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলোচনা করছে। হঠাৎ দেখে মেয়েটা উলটো দিকে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে আর চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছে। ওদের বাড়িটা রাস্তার এ ধারে উলটোদিকের গলিতে। প্রথমে না বুঝতে পারলেও ইন্দ্রকে ভেংচি কাটাতে বুঝতে পারল। ইন্দ্র যা যা অঙ্গভঙ্গি করছে মেয়েটা তাই করছে। আর মাঝে মাঝে হাসছে। এমনটা দেখে ইন্দ্ৰও হেসে ফেলল।
এমন চিন্তা এই প্রথম জন্মাল ইন্দ্রের মনে, কেউ একজন তাকে চায়! হোস্টেলের অনেক ছেলেরই প্রেম ছিল। চারদিকে যা প্রেমের পরিস্থিতি তাতে ইন্দ্ররও প্রেম করতে ইচ্ছে করত। তবে প্রেম ও বিয়ে তখনও তার মনে সম্পূর্ণতা লাভ করেনি। সেদিনের সেই ঘটনা বন্ধুদের বলতে অনেকেই উৎসাহ দিল। অনেকে কমলবাবুর বড়ো মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করতে বলল। এলাকায় কমলবাবুর নাম আছে।
খিদিরপুরের ইস্কুলের বেশকিছু বন্ধু এই অঞ্চলে থাকত। তার মধ্যে সুব্রত, নব, প্রকাশ আছে। এদের সঙ্গে ইন্দ্রর নতুন করে দেখা হয়েছে। তবে এখানকার বন্ধুত্বের চেয়ে হোস্টেলের যেরকম বন্ধুত্ব ছিল তার রীতিনীতিই আলাদা ছিল। তিন বছরের জন্য এক জায়গায় অন্তত রাত্তিরের থাকবার জায়গাগুলো হওয়ায় বেশ মাখামাখি ছিল। সেই অভ্যাসেই খিদিরপুরে ফিরে প্রথম প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়ে দিয়েছিল ইন্দ্র। সুব্রতর অঙ্কর অনার্স কেটে গেছে। নব এমকম পড়ছে। প্রকাশ বাবার ব্যাবসায়। ইন্দ্রদের স্কুলের ফার্স্টবয় নির্মাল্য এখন যাদবপুরে বিই পড়ছে। নির্মাল্য ওদিকের পাড়াটায় থাকে। মাঝে মাঝে বাড়ি এলে এ পাড়ায় আড্ডা জমায়।
ইন্দ্রদের নতুন পাড়ায় একটা দুর্গাপুজো হয়। সে বছর নতুন আসায় পুজোটা বেশ ভালোই লেগেছিল। দুর্গাপুজো মানেই চার-পাঁচদিন বাড়ির বাইরে অনেকেরই সঙ্গে মেলামেশা হয় রাতদিন। নব, সুব্রত, প্রকাশ তো ছিলই নির্মাল্যও এসে পাড়ার আড্ডায় যোগ দিয়েছিল। এই অবসরে কমলবাবুর মেয়ের নামটাও জেনে নিয়েছে। ঈপ্সিতা। প্রকাশই নামটা জানিয়েছে আর বলেছে, ‘ওর দিদির নাম ইন্দিরা। তুই যদি এটাকে চাস, আমি তাহলে বড়োটাকে।’
(ক্রমশ…)