শ্রীরামপুর বটতলার কাছে আসতেই সপ্তর্ষির মোটরবাইকটা থেমে গেল লাল সিগন্যাল দেখে। সামনে প্রচণ্ড জ্যাম। বাস, সাইকেল, গাড়ি লোকের চিৎকারে কানপাতা দায়। সকলেরই রয়েছে কাজের তাড়া। এরই মধ্যে বুকপকেটের মোবাইলে বেজে উঠল সপ্তর্ষির প্রিয় গান, ‘তুম কো পায়া হ্যায় তো জ্যায়সে খোয়া হুঁ, কহনা চাই ভি তো তুমসে কেয়া কহুঁ…’ সুইচ অন করতেই ওপারের রিংটোনটা বলে উঠল, “তোর রোমিকে দেখলাম মল্লিকপাড়ার পুজো প্যান্ডেলে দীপাংশুর হাত ধরে ঘুরছে।’

—তাতে আমার কী?’ সপ্তর্ষির গলাটা একটু চড়া সুরে বাজল।

প্রায় সাত মাস হল সামান্য কারণে রোমির সঙ্গে তার প্রেম চটকে গিয়েছে। গত বছর পুজোয় রোমি সপ্তর্ষির কাছে টিউনিক ও হারেম প্যান্ট আবদার করেছিল। দাম এমন কিছু নয়, মাত্র হাজার টাকা। দামটা ফ্যাক্টর নয়। রোমির যা চেহারা, তাতে ওই পোশাক পরলে বেখাপ্পা লাগবে ওকে। কিন্তু রোমি মানতে চায়নি। তার ধারণা সে যা পরবে, তাতেই তাকে বিউটি কুইনের মতো লাগবে। সপ্তর্ষিকে বাজিয়ে নিতে চেয়েছিল রোমি, তার পিছনে তার প্রেমিকের খরচ করার ক্ষমতা কতটা আছে। যে-ছেলে বিয়ের আগে রোমির পছন্দের জামা কিনতে গিয়ে পিছিয়ে আসে, বিয়ের পরে তার হাতটান তো হবেই। সে কারণে রোমি সপ্তর্ষিকে ছেড়ে, ব্যাংক ম্যানেজারের ছেলে দীপাংশুর দিকে ঝুঁকেছে। সামান্য স্কুল মাস্টারের ছেলে সপ্তর্ষি তার কাছে নগণ্য। রোমির মতো আলট্রা মডার্ন মেয়ের কাছে টাকাই বড়ো, প্রেম-ট্রেম সব ফালতু।

ভগবান যা করেন, সব মঙ্গলের জন্যই করেন। রোমি সপ্তর্ষির জীবন থেকে সরে গিয়ে ভালোই হয়েছে। এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজটা মন দিয়ে করতে পারছে সে। রোমির সঙ্গে সম্পর্ক ঢুকে যাওয়ার পর কম্পিউটার মেশিন রিপেয়ারিং করার কাজও হাতে আসছে। আগে তাকে দিয়ে কম্পিউটার মেশিন সারাতে কেউ ভরসা পেত না। আর এখন এক বিখ্যাত সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার তাকে ফোন করছে হামেশাই।

রোমি দত্তর কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। খামোখা তার বন্ধু রিজার্ভ ব্যাংকের হেড ক্লার্ক বরুণ, মোবাইলে ফোন করে খুঁচিয়ে ঘা করল। অকারণে ক্ষতবিক্ষত হল তার কথা শুনে, ‘বন্ধু হিসেবে রোমির খবরটা তোকে জানানো উচিত বলে মনে করি। যাই হোক রাগ করিস না। আজ অঞ্জননগরের পুজো প্যান্ডেলে বিকেলে আসছিস তো? জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে। তোর জন্য একটা রাশিয়ান ভদকা রেখেছি। শালা খেলেই বিগ বস হয়ে যাবি!”

সপ্তর্ষি কোনও উত্তর না দিয়ে, গ্রিন সিগন্যাল দেখে ফোনের লাইনটা কেটে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। দে স্ট্রিটে ঢুকতেই রাস্তার ডানদিকে চোখে পড়ল ঝাঁ চকচকে শপিং মল।

পুজোর অষ্টমীর দিন কেনাকাটা করতে মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু অনেক দিন পর তার মাসতুতো দিদি ফুলদি আর জামাইবাবু বালিগঞ্জ থেকে বেড়াতে এসেছে। পুজোর ক’টা দিন এখানেই থাকবে। ছোটোবেলায় সপ্তর্ষি কলকাতায় বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ার মাসিমার বাড়ি গেলে, মনে হতো যেন সে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে চলে এসেছে।

সকাল থেকেই চিলড্রেনস পার্কে গিয়ে স্লিপ খাওয়া, তারপর বঙ্কার দোকানের গরম কচুরি— সত্যি সে সব ভোলার নয়। সবচেয়ে ভালো লাগত ফুলদির স্নেহমাখা হাতের স্পর্শ আর দুপুরবেলায় ওর ঘুমপাড়ানি গান, ‘মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই…’ বিয়ের পর ফুলদি শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর, সপ্তর্ষি মাসিমার বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ফুলদি শুধু তার মাসতুতো দিদিই নয়, বন্ধুও। তাকে কোনও কথা না বলে সে থাকতে পারে না। এমনকী রোমির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটাও ফুলদিকে এসএমএস করে জানিয়েছে সে।

ফুলদিও তাকে এসএমএস করে জানিয়েছিল, ‘প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়া ভালো, তার ফলে শিক্ষা লাভ হয়। দেখবি তোর দ্বিতীয় প্রেমটা খুব সুখের হবে। তার কথা সপ্তর্ষিকে চলার পথে প্রেরণা দিয়েছে। বালিগঞ্জ থেকে ফুলদি আসায় সপ্তর্ষির বুকে অষ্টমীর ঢ্যাংকুড়কুড় বাজনাটা সুখের হয়ে উঠেছে এবং ভুলতে পেরেছে রোমিকে হারানোর দুঃখটা। ফুলদির জন্যই তার এই শপিং মলে আসা। তার হাতের রান্না পোলাও যেন অমৃত। বাদশাহি পোলাও রান্না করতে যা যা প্রয়োজন, সে সব ফুলদি লিস্ট করে দিয়েছে।

বাইক থেকে নেমে সপ্তর্ষি শপিং মলের সামনে আসতেই নীল ইউনিফর্ম পরা একজন কর্মচারী ঝাঁ চকচকে কাচের দরজা খুলে দিয়ে স্বাগত জানাল। তার হাতে কোনও ভারী ব্যাগ নেই। থাকলে এখানকার নিয়ম অনুযায়ী কর্মচারীটির কাছে ব্যাগ জমা দিয়ে নম্বর লাগানো প্ল্যাস্টিকের টোকেন নিতে হতো।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সাদা ধবধবে পাথরের মেঝেতে পা রাখতেই বোঝা গেল চারদিকে কোনও কোলাহল নেই। সকলেই কেমন নিঃশব্দে র‍্যাক থেকে পছন্দমতো প্যাকিং করা জিনিস নিয়ে হ্যান্ডট্রলিতে রাখছে এবং ইচ্ছেমতো এগিয়ে যাচ্ছে অন্য র‍্যাকের দিকে। এত বড়ো একটা হলঘরের মধ্যে র‍্যাকে ঠাসা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় হরেকরকম জিনিস দেখে সপ্তর্ষির ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গুপ্তধনের কথা’ মনে হল। ভেজিটেরিয়ান র‍্যাক থেকে এক লিটারের ঘিয়ের হলুদ বাক্সটা হাতে নিতেই দুর্লভ সুগন্ধ ভেসে এল নাকে। ঘিয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কাজু-কিশমিশের দিকে পা বাড়াতেই সপ্তর্ষির কানের কাছে ভেসে এল মেয়েলি গলায় মিষ্টি কন্ঠস্বর, ‘আপনার গগল্সটা মাটিতে পড়েছিল।’

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...