অনেকসময় শৈশবেই বহু শিশুর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে ভীষণ বিচলিত এবং ভীত হয়ে পড়েন। তবে এক্ষেত্রে ভয় না পেয়ে, বাচ্চার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। কেন না মানসিক সমস্যা অনেক সময় শারীরিক সমস্যার চেয়েও মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রয়োজন হয় সঠিক চিকিৎসার। প্রথম থেকেই যদি সঠিক চিকিৎসা হয় তাহলে বাচ্চারা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। শিশুদের মানসিক রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখার প্রয়োজন সকলেরই।
- শিশুদের খারাপ আচরণ মানেই কি মানসিক সমস্যা?
- শিশুদের মধ্যে কেন মানসিক সমস্যা দেখা দেয় ?
- শিশুদের মানসিক রোগ ও লক্ষণ সমূহ।
- শিশুদের কী কী ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে?
* অটিজম
* ডিসলেক্সিয়া
* শর্ট টার্ম মেমরি লস
* ক্লেপটোম্যানিয়া
* এডিএইচডি
* কনডাক্ট ডিসঅর্ডার
* অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিসঅর্ডার
- এইসব সমস্যার সম্মুখীন হলে করণীয় কী?
শিশুদের খারাপ আচরণ মানেই কি মানসিক সমস্যা ?
অনেক সময় শিশুরা খুব দুষ্টু আর চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় তারা খারাপ আচরণ করে ফেলে। আর এই বিরূপ আচার-আচরণ মানেই কিন্তু মানসিক সমস্যা নয়। সাধারণত অভিভাবকদের পজেটিভ পেরেন্টিং এই ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করে। তবে অবশ্যই নিজের সন্তানের দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে এবং সে কেন এই ধরনের আচরণ করছে সেটা বুঝে, তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বাচ্চা যদি অতিরিক্ত জেদি, একগুঁয়ে ও অবাধ্য আচরণ করে এবং তা অভিভাবকের পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে, তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
শিশুদের মধ্যে কেন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়?
সাধারণত অনেক কারণে বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে জেনেটিক, বিরূপ পরিবেশ, কোনও শারীরিক রোগ, বড়ো কোনও দুর্ঘটনা বা ভুল পেরেন্টিং ইত্যাদির কারণে শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যে যদি কোনও অস্বাভাবিক আচার-আচরণ কেউ দেখেন, তবে দেরি না করে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া দরকার।
শিশুদের মানসিক রোগ ও লক্ষণ
বেশিরভাগ ছোটো বাচ্চাই চঞ্চল প্রকৃতির হয় এবং বিভিন্ন ধরনের আচার আচরণ করে থাকে৷ সেক্ষেত্রে সবসময় যে, কোনও সমস্যা বা অসুস্থতার কারণে এমনটা করে তা কিন্তু নয়। তবে আপনার সন্তান যদি দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করছে দেখেন, তাহলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই প্রসঙ্গে সাইকোলজিস্ট-দের মত হল, অনেক সময় শিশুদের আচরণে সমস্যা তৈরি হয়। তখন সে রেগে যায়, ভাঙচুর করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। এছাড়াও সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারে না, পড়াশোনায় আগ্রহ থাকে না, ঠিকমতো ঘুম ও খাওয়াদাওয়া করে না। এসব লক্ষণ দেখা গেলে বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
- শিশু সমবয়সি বাচ্চাদের থেকে আলাদা এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।
- সবকিছুতে অতিরিক্ত চঞ্চলতা, রাগ, জেদ এবং অবাধ্য আচরণ করে।
- অনেকসময় অতিরিক্ত রেগে গিয়ে নিজেকে কিংবা অন্যকে আঘাত করে বসে।
- বাচ্চা সারাক্ষণ বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগে৷
- অন্যের প্রতি প্রতিশোধমূলক এবং উগ্র আচরণ করে থাকে।
- শিশু ঘন ঘন মাথা ঝাঁকায়।
- অস্থিরতা, ভুলে যাওয়া এবং উদভ্রান্তের মতো ছটফট আচরণ করে।
- কোনও কিছু নিয়ে অস্থিরতা দেখায় এবং একটানা কাঁদতে থাকে।
- দৃষ্টিকটু এবং নেতিবাচক আচরণ করে থাকে।
- বাচ্চা রুটিন অনুযায়ী কাজ করতে পছন্দ করে না।
- অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয় এবং নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। শিশু অনেক দেরিতে কথা বলা শেখে এবং বিভিন্ন কাজকর্মে অপটু হয়ে থাকে। অতিরিক্ত দুষ্টুমি এবং বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
- বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা কম হয় এবং অ্যাবনর্মাল আচরণ করে।
- অনেক সময় ডাকলে সাড়া দেয় না বরং আত্মমগ্ন অবস্থায় থাকে।
- অনেক ক্ষেত্রে বাইরের কাউকে কিংবা অন্য কোনও মানুষের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না।
অটিজম
অটিজম বা অটিস্টিক একটি মনোবিকাশগত সমস্যা। এটি একটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক সমস্যা। মূলত এই সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার বলা হয়। এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে তারা কথা বলতে অথবা কিছু বুঝতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং স্বাভাবিক ভাবে চলতে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এছাড়াও এতে আক্রান্তদের মধ্যে সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বধিরতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে।
ডিসলেক্সিয়া
সাধারণত ডিসলেক্সিয়া এক ধরনের লার্নিং ডিসেবিলিটি। এতে বাচ্চাদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। এতে আক্রান্ত শিশুদের পর্যাপ্ত বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্ত্বেও তারা সেভাবে পড়া মনে রাখতে পারে না। এই রোগে আক্রান্ত হলে তারা বিশেষ কিছু অক্ষর, শব্দ ইত্যাদি মনে রাখতে বেশ সমস্যায় পড়ে যায়। আবার অনেক সময় ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের মধ্যে স্মৃতিভ্রমও দেখা দিতে পারে।
শর্ট টার্ম মেমরি লস
মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতাকে বলে শর্ট টার্ম মেমরি লস বা স্মৃতিভ্রম। অনেকসময় শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্রেইন টিউমার, মাথায় আঘাত পাওয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি কারণেও এই ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ক্লেপটোম্যানিয়া
সাধারণত ক্লেপটোম্যানিয়ায় মানুষ চুরি করে। অনেক সময় শিশু-কিশোররা এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মূলত এতে আক্রান্তরা কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই চুরি করে থাকে। এতে রোগী চুরি করতে না পারা পর্যন্ত অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। চুরি করতে পারলে আত্মতুষ্টি পায়। গবেষকদের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য হওয়ার কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
এডিএইচডি
এই এডিএইচডি বাচ্চাদের এক ধরনের আচরণগত সমস্যা। এতে আক্রান্ত শিশুরা অনেক ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকে। আর তারা কোনও কাজই পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের মাঝে ভীষণ অস্থিরতা এবং কাজকর্ম অসম্পূর্ণ করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও এই সমস্যার ফলে শিশুদের মধ্যে সাময়িক স্মৃতিভ্রম বা শর্ট টার্ম মেমরি লস দেখা দিতে পারে।
কনডাক্ট ডিসঅর্ডার
কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরীর চরিত্রে অতিরিক্ত আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বাচ্চার দুরন্ত স্বভাব অথবা অবাধ্যতাকে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার বলে ধরা হয়। মূলত এটি কৈশোরের একটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত।
অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিসঅর্ডার
শিশুদের মধ্যে ব্যাঘাতমূলক আচরণগত রোগ হল অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিসঅর্ডার। এটি আচার আচরণ এবং আবেগের আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সমস্যা তৈরি করে। এতে বাচ্চারা আক্রমণাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব প্রদর্শন করে। এটির কারণে তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এই সব সমস্যার সম্মুখীন হলে করণীয় কী?
সন্তানের মধ্যে এই সব মানসিক রোগ দেখা দিলে ভেঙে না পড়ে ধৈর্য ধরতে হবে। বর্তমানে শিশুদের মানসিক সমস্যার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আধুনিক এবং কার্যকরী চিকিৎসার মাধ্যমে বাচ্চা সুস্থ স্বাভাবিক এবং সুন্দর জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। সাইকায়াট্রিক ডাক্তার কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা বাচ্চার রোগ নির্ণয় করে যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।
মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মানসিক রোগ মানেই পাগল নয়। যে-কোনও বয়সেই যে-কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিলে, বিচলিত না হয়ে এবং কুসংস্কারের ফাঁদে না পড়ে, তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।