দরজা খুলে অচেনা দুটো মেয়েকে দেখে তিয়াসের মা জিজ্ঞাসা করল, “কাকে খুঁজছ মা?”
তিন্নির কানে তখন কোনও কথা ঢুকছে না। এক মনে শুধু ঠাকুরকে ডাকছে, তিয়াস যেন বাড়িতে না থাকে, না-থাকে, না থাকে…
তিন্নিকে কিছু বলতে না দেখে রঞ্জনাই বলল, “তিয়াস আছে?” —না মা। ও তো একটু বেরিয়েছে।
—ও কখন আসবে?
—ডাক্তারের কাছে গেছে তো… কতক্ষণ লাগে!
—ডাক্তারের কাছে কেন? ওর কি কিছু হয়েছে?
—না। ওর কিছু হয়নি। ওর ছেলেটা তো ক’দিন ধরে খুব ভুগছে…
—ছেলে! তিন্নির পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। চারশো চল্লিশ ভোল্টের বিদ্যুৎ আছড়ে পড়ল তার ওপর। থরথর করে কেঁপে উঠল তিন্নি। তিয়াসের ছেলে আছে! ও বিবাহিত! তিন্নি এর আগে বিভিন্ন খবরের কাগজে পড়েছে, বদমায়েশ গোছের কিছু লোক আছে, যারা বিয়ের পরেও নিজের নাম ভাঁড়িয়ে, পরিচয় গোপন করে একের পর এক বিয়ে করে। কারও কারও কাছে এটা আবার পেশাও। যৌতুক হিসেবে যতটা যা গেল, পেল। বিয়ের পর দিন কিংবা তার ক’দিন পরে ‘একটু আসছি” বলে কিংবা সদ্য বিয়ে করা বউকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সব সোনাদানা নিয়ে চম্পট দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তার আগের বউও নাকি তার সঙ্গে সেঁটে থাকে। ভাবা যায়! এগুলো অবশ্য গ্রামের দিকেই বেশি হয়। তা বলে কি শহরে হয় না! শহরেও কিছু কিছু ছেলে আছে, যারা বাড়িতে বউ-বাচ্চা থাকলেও অন্য মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে। এবং কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়লেও সে যে বিবাহিত, সেটা বেমালুম চেপে যায়। এ সব এখন আকছারই ঘটে। কিন্তু তার জীবনে যে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি।
কিছু দিন ধরে তিন্নি ওকে সন্দেহ করছিল ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটা যে এতখানি, সেটা ভাবতেই পারেনি ও। ভেবেছিল, ও হয়তো অন্য কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। সেটা হয়তো ওর বাড়ির লোকেরা জানে। মেয়েটা হয়তো ওদের বাড়িতেও যাতায়াত করে। ওর মায়ের হয়তো তাতে সম্মতিও আছে। এ দিকে তার সঙ্গে এত দিনের সম্পর্ক, তাই তার মুখের উপরে সরাসরি না-ও বলতে পারছে না। তাই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোকেরা যাতে জানতে না পারে, সে জন্যই হয়তো বাড়িতে ঢুকেই মোবাইল অফ করে দিচ্ছে। কিন্তু এটা কী শুনল সে! কী! চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। ঝাপসা চোখে রঞ্জনার দিকে তাকাল। দেখল, রঞ্জনাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনও কথা হল না। তবু যেন চোখে চোখে কত কথা হয়ে গেল। তা হলে এত দিন ধরে তিয়াস তার সঙ্গে খেলা করছিল! ছি ছি ছিঃ….
দুটো মেয়ে যখন এসে তিয়াসের খোঁজ করছে, নিশ্চয়ই এরা তিয়াসের বন্ধু হবে। সন্তানের বন্ধু তো সন্তানের মতোই। তাদের কি দোরগোড়া থেকে খালি মুখে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! তাই ভদ্রমহিলা বললেন, “ভিতরে এসো।’
—না না, ঠিক আছে মাসিমা। ও যখন নেই… পরে অন্য একদিন আসব’খন!
রঞ্জনা বললেও তিন্নি তখন হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা কোনও কাজ করছে না। সারা মুখ জুড়ে থমকে আছে একরাশ কালো মেঘ। আর বুকের মধ্যে সে কী হাহাকার! কান্না পেয়ে গেল তার। কিন্তু না, সে কাঁদবে না। তিয়াসকে সামনে পেলে সে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবে, ও কেন তার সঙ্গে এ রকম করল? কেন? কেন? কেন? এটা তাকে জানতেই হবে। না, সে এখন বাড়ি যাবে না। তিয়াসের সঙ্গে আগে দেখা করবে, তার পরে অন্য কথা। কিন্তু তিয়াসের মাকে সেটা বুঝতে দিল না সে। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রঞ্জনাকে বলল, ‘চল না, উনি যখন বলছেন…
রঞ্জনা বলল, ‘ও কখন আসবে তার কোনও ঠিক আছে!”
—ডাক্তার দেখাতে আর কতক্ষণ লাগবে?
তিন্নি বলতেই তিয়াসের মা-ও সায় দিলেন, ‘না না, বেশিক্ষণ লাগবে না। এই তো সামনেই গেছে। আমার মনে হয়, এক্ষুনি চলে আসবে। ফোন করে দেখতে পারো। ওর কাছে তো মোবাইল আছে।’
রঞ্জনা বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন তো। অ্যাই, তোর কাছে ওর নম্বর আছে না?’
—আছে। কিন্তু এখন করা কি ঠিক হবে? ডাক্তারের কাছে গেছে যখন, ফোন করে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না। ধীরে-সুস্থে ডাক্তার দেখাক। আমরা বরং একটু অপেক্ষা করি, নাকি? কী বলিস?
—কতক্ষণ বসবি?
—খানিকক্ষণ তো বসি…
—যদি তার মধ্যে না আসে?
—তখন না হয় ফোন করব। কিংবা একটা চিঠি লিখে যাব।
তিয়াসের মা বললেন, “হ্যাঁ মা, সেটাই ভালো। আমার বয়স হচ্ছে তো। কোনও কিছু আর মনে রাখতে পারি না। তোমরা বলে গেলেও, তোমাদের নাম হয়তো ঠিক মতো মনে করে আমি ওকে বলতেও পারব না। রোদের মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থেকো না। এসো এসো, ভিতরে এসো।’
ওরা ভিতরে ঢুকল। কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার মতো। পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি। সামনেই বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বসার ঘর। খুব একটা সাজানো গোছানো নয়। মুখোমুখি যে চারটে সোফা, সেগুলোও ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ। মাঝখানে সেন্টার টেবিল। তাতে কয়েকটা মাগাজিন। সোফায় বসতে বসতে তিন্নিরা দেখল, ও দিক দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। তিয়াসের মা পাখার সুইচ অন করতে করতে বললেন, ‘একটু চা খাবে তো মা?”
দু’জনেই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘না না, থাক না।’
—থাকবে কেন? তিয়াস থাকলে কি চা না খেয়ে তোমরা যেতে পারতে? তোমরা চায়ে চিনি খাও তো? রঞ্জনা বলল, ‘হ্যাঁ খাই।”
কিন্তু না, চা নয়— একটা ট্রে-তে চাপিয়ে আলাদা দুটো প্লেটে দুটো করে ছানার সন্দেশ আর দু’গেলাস জল দিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, আগে এটা খেয়ে নাও।
রঞ্জনা বলল, “এ সবের কী দরকার ছিল মাসিমা…’
—নাও নাও, খাও। লজ্জা কোরো না। আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছি।
ভদ্রমহিলা পিছন ফিরতেই প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে ঠোঁট দিয়ে আলতো করে একটুখানি ভেঙে মুখে নিল রঞ্জনা। টুকরোটা মুখে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দেখল, তিন্নির মুখ একেবারে থমথমে। চোখটাও ছলছল করছে। যেন এক্ষুনি বাঁধ ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসবে। তাই রঞ্জনা বলল, ‘এ রকম করিস না। উনি কী ভাববেন বল তো… নে, খা।”
কান্না ভেজানো গলায় তিন্নি বলল, “না রে আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না।’
—বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবি বল। তবু আজ এলি দেখে তো ব্যাপারটা জানতে পারলি। না এলে তো জানতেই পারতিস না। কাঁপা কাঁপা গলায় তিন্নি বলল, ‘আমি এত বড়ো ভুল করলাম! মানুষ চিনতে আমার এত বড়ো ভুল হল!”
(ক্রমশ…)