এ বার একটু থতমত খেয়ে গেল তিন্নি। বলল, ‘না মানে… শুনলাম ছেলেকে নিয়ে তোমার দাদা ডাক্তার দেখাতে গেছে।’
কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে উঠল ঝিনুক। ও, তুমি দাদার ছেলেকে চেনো না? বলেই হাসতে হাসতে কোলের খরগোশটাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই তো দাদার ছেলে!”
—এটা !
—হ্যাঁ, এই খরগোশটাকে ও এত ভালোবাসে যে আমাদের বাড়ির লোকেরাই শুধু না, গোটা পাড়ার সবাই বলে, এটা ওর ছেলে।
—আর মেয়ে?
মেয়ে তো উপরে। ইয়া বড়ো। একেবারে বাঘের মতো। দেখলে কেউ বলবে না, ও কুকুর। ভীষণ বুঝদার। আমাদের প্রত্যেকের পায়ের শব্দ চেনে। আমাদের কলিংবেল টেপার শব্দ শুনেই বুঝতে পারে, কে এসেছে। টিভি চালিয়ে দিলে নীচে আর নামতেই চায় না। বসে বসে টিভি দেখে!
ঝিনুক বলেই যাচ্ছিল। আর সেটা হাঁ করে গিলছিল তিন্নি। সে কত কী না ভেবেছিল! আর যাকে নিয়ে তার এত সন্দেহ, সে কিনা একটা কুকুর! মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়েও এল শেষ শব্দটা— কুকুর!
—হ্যাঁ। কেন, তুমি কী ভেবেছিলে? বলেই, তিয়াসের দিকে তাকিয়ে ঝিনুক বলল, ‘কী রে দাদা, তুই ওকে তোর ছেলেমেয়ের কথা বলিসনি?”
ঢোঁক গিলে তিয়াস বলল, ‘আসলে আলাপের প্রথম দিনই আমি যখন জানতে পারলাম ও কুকুরকে ভীষণ ভয় পায়, কুকুর থেকে একশো হাত দূরে থাকে— তখন আমার মনে হয়েছিল আমাদের বাড়িতে কুকুর আছে শুনলে ও হয়তো এই কুকুরের ভয়েই আমার সঙ্গে আর মিশবে না। তাই…’
—তাই বলিসনি? তুই কী রে?
রঞ্জনা বলল, “সে নয় বলেননি ঠিক আছে। কিন্তু বাড়ি ঢুকলেই মোবাইলটা অফ করে দেন কেন?”
তিয়াস মাথা নত করে বলল, ‘না মানে আসলে অবলা জীব তো, ও তো অতশত বোঝে না। যদি হঠাৎ কখনও ডেকে ওঠে আর সেই ডাক শুনে যদি তিন্নি জেনে যায় আমাদের বাড়িতে কুকুর আছে তাই….
—সে জন্য মোবাইল অফ করে দিতে? সে জন্যই ল্যান্ড নম্বর দাওনি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল তিন্নি।
—না মানে আসলে…
রঞ্জনা বলল, ‘ও যখন ফোন করত, আপনি রাস্তায় থাকলে, আপনার সঙ্গে তখন কে থাকত?”
—আমার সঙ্গে? কে ?
—কেউ না থাকলে কথা বলতে বলতে তুমি অন্যমনস্ক হয়ে যাও কেন?
তিন্নি জানতে চাইতেই তিয়াস বলল, ‘আসলে তুমি ফোন করলেই আমি তটস্থ হয়ে যেতাম। দেখতাম, আশপাশে কোনও কুকুর আছে কি না। ভয়ে ভয়ে থাকতাম, হঠাৎ কোনও কুকুর ডেকে উঠবে না তো!”
—তা হলে তমন্না ওই কথা বলল কেন? ফের প্রশ্ন করল তিন্নি।
—কোন কথা?
—তুমি খুব একটা সুবিধের না।
-আমি সুবিধের না? এটা তোমার মনে হল?
—এটা আমি বলছি না।
—তাহলে?
—তমন্না বলেছিল।
—সে তো বলবেই।
—কেন?
—কারণ, বাচ্চা।
—কার?
—আমার মেয়ের।
—তোমার মেয়ের? আঁতকে উঠল তিন্নি।
সেটা দেখেই তিয়াস তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘না না আমার মেয়ের না। আমার ডগির বাচ্চা। ওর বাচ্চা হবে শুনে তমন্না আমাকে আগেই বলেছিল, ওর বাচ্চা হলে আমাকে একটা দিস। আমিও বলেছিলাম, দেব। কিন্তু বেচারি তিনটে বাচ্চা দিলেও সব ক’টারই ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বাঁচাতে পারিনি। তমন্না সে কথা বিশ্বাস করেনি। ও ভেবেছিল, আমি বুঝি কারও কাছে তিনটে বাচ্চাই বিক্রি করে দিয়েছি। তাই বলেছিল, তুই আমাকে বললে কি আমি টাকা দিতাম না?”
শুনে, আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। আমি ওকে যা-তা বলেছিলাম। সেই থেকেই ওর সঙ্গে আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। মাঝে মাঝে এর তার মুখে খবর পাই, বিভিন্ন লোকের কাছে আমার নামে ও যা তা বলে। বলে, আমি নাকি মিথ্যাবাদী। লোককে কথা দিয়েও কথা রাখি না। আমি নাকি মোটেও সুবিধের না। তা হলে আমার নামে তোমাকেও বলেছিল?
—হ্যাঁ, বলেছিল তো। কিন্তু তুমি আমাকে এসব আগে বলোনি কেন?
এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সে! কিছু একটা বলতে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগল। দাদাকে বিব্রত হতে দেখে তিন্নির দিকে তাকিয়ে ঝিনুক বলল, ‘তুমিও পারো বাবা! কবে কোন কুকুর তোমাকে একবার কামড়েছে, সেই জন্য তুমি পৃথিবীর সব কুকুরকেই ভয় করতে শুরু করে দিয়েছ? তুমি জানো, শুধু কুকুর নয়, তুমি যদি বিষাক্ত সাপকেও ভালোবাসো— সে ভুল করেও তোমাকে কখনও ছোবল মারবে না। কারণ পশুপাখিরাও ঠিক বুঝতে পারে, কে তাকে ভালোবাসে। বুঝেছ?”
মাথা কাত করতে করতে তিন্নি যখন দেখল, সন্দেশ শেষ করে রঞ্জনা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়েছে, তখন সে-ও প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে অর্ধেকটায় কামড় বসিয়ে দিল। আর সেটা দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল রঞ্জনা। বলল, ‘কী রে, গলা দিয়ে এ বার নামবে তো?’
সন্দেশ খেতে খেতেই মাথা কাত করল তিন্নি। বোঝাতে চাইল, নামবে। খুব নামবে।
(সমাপ্ত)