কত সফর যে জেগে থাকে ভ্রামণিক জীবন অভিজ্ঞতায়। কখনও কখনও ঘরের বাঁধনকেও বুঝি তখন নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়। বাউন্ডুলে মনটা শীতঘুম কাটিয়ে আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে আর তখনই শুরু হয়ে যায় অচিন পথে বেরিয়ে পড়ার নানান অন্ধিসন্ধি। পৌঁছে যাই পাহাড়ের কাছে, নদীর কাছে। মন উজানের টানে কোথায় পাড়ি জমানো যায়— ভাবনাটা গাঢ় হতে না হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই ‘ডুয়ার্স’। কাছে, তবু দূরের সেই ‘দুয়ার’, অভিসারী পদক্ষেপে পৌঁছে যাওয়া, নতুন গন্তব্যে। হাতের কাছে যে কত স্বপ্নের মতো জায়গা আছে ডুয়ার্সের ত্রিসীমানা জুড়ে।
সবুজ সোহাগের প্রীত সম্ভাষণে জানি না কতদূর ভেসে গেছে ডুয়ার্সের হৃদিকথা। এই সফরে ঘনঘটা নেই তেমন। শুধুই পাহাড় ও চায়ের আবাদভূমির ভূমিকা। গন্তব্য চালসা-মাটিয়ালি হয়ে আরও ওদিকের কিছু ভ্রমণ ঠিকানা। শালুগোড়া পেরিয়ে ডানপাশে অনেকখানি জুড়ে সেনাছাউনি। তারপর উত্তর-পূর্বে মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুক চিরে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক বা সেবক রোড ধরে এগিয়ে চলা।
শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ১২৭.২২ বর্গকিলোমিটার জুড়ে মহানন্দা অভয়ারণ্য। মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে পঞ্চনই নদী। দু’পাশে গহিন জঙ্গলের মিশ্র বনজঘ্রাণ বাতাসে। উন্মাদনায় দিশেহারা করে পথশোভা। নন্দীখোলা নদীর পাশে, মহানন্দার জঙ্গল ক্রমশ ফিকে হয়। পারিজাত নগরে নন্দীখোলা তিস্তার অপার সান্নিধ্যে মেশে। তিস্তার ওপর করোনেশন ব্রিজ বা বাঘপুল সেতু। ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রানি এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক স্মরণে এই ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ১৯৪১ সালে সম্পন্ন হয়।
তিস্তা নদীর গভীরতা ও স্রোতের কারণে এই ব্রিজ পিলার ছাড়াই ‘ফিক্সড আর্চ” বা খিলান ব্যবহারে নির্মিত হয়। জায়গাটার নাম স্বস্তিক সেক্টর। বাঁদিকে সেবকেশ্বরী কালিমন্দির। ‘সেবক’ কথার অন্য অর্থ ‘হাওয়ার দরজা’। কিছু ঘরবাড়ি, ধাবা, দোকানপাট-সহ ছোট্ট জনপদ। নুড়িপাথরের গা ঘেঁষে বহতা তিস্তাকে পাশে নিয়ে চলতে চলতেই খাড়াই পথ শুরু। তিস্তা পার হওয়া মানেই তরাই ছেড়ে ডুয়ার্সের শুরু। এই পাহাড়িপথের দুপাশে বাঁদরদের বাঁদরামি গাড়ির জানলা দিয়ে উপভোগ করছিলাম।
দিগন্ত জুড়ে ছায়া-রোদের প্রস্তাবে নিয়মমাফিক অনিবার্য শরণার্থী সবুজ। পশ্চিম ডুয়ার্সের প্রথম চা-বাগান ওয়াশাবাড়ি টি এস্টেট। সবুজ কিন্তু ফুরল না সহজে। নুড়ি-পাথর ছাওয়া শুষ্ক লিস নদী পেরিয়ে সোনালি টি এস্টেট, বাগরাকোট টি গার্ডেন। বিখ্যাত ডানকান চা, এই বাগরাকোট চা-বাগিচার সবুজতরঙ্গ।
গণেশ নদী পেরিয়ে নেশা জাগানো সবুজে চোখ রেখেই এসে যায় ওদলাবাড়ি। দোকানপাট, বাজার নিয়ে ওদলাবাড়ি বেশ জনবহুল এলাকা। ওদলাবাড়ি হাট ডুয়ার্সের প্রাচীনতম। তার দু’ধারে অঢেল বেড়ানোর জায়গা, ক্ষয়ে যাওয়া জঙ্গল, পাহাড়তলি। এইভাবে কখনও সবজে নিবিড়তা, কখনও ঝিমঝিম স্তব্ধতায় এক একটি মায়াময় চা-বাগিচা, যত্রতত্র নিঝুম বয়ে চলা অজস্র পাহাড়ি নদী, খোলা, ঝোরা, চড়াই-উতরাই পাহাড়িপথ, দু-একটা শহর, অগণিত গ্রাম-জনপদ, শাল-সেগুনের জঙ্গল। একটু তফাত রেখে সমান্তরালে পাহাড়শ্রেণি। সে এক অনন্য ডুয়ার্স।
১৮৭৪ সালে এখানে চা-বাগিচার পত্তন করেন মিস্টার ব্রুহাম নামক এক ব্রিটিশ আধিকারিক। যদিও তার অনেক আগেই আসামের চা-বাগানগুলিতে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রচুর চা চাষ হতো। তবে জলপাইগুড়ি সংলগ্ন অসংখ্য নদী ও জঙ্গলঘেরা ডুয়ার্স অঞ্চলে চা চাষের দেরি হওয়ার কারণ, এটি তখন ভুটান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। পরে ভুটানরাজকে পরাস্ত করে ব্রিটিশরা এই সমগ্র অঞ্চলের মালিকানা হস্তগত করে এবং পরে ডুয়ার্স অঞ্চলটির পত্তন হয়। নাম না জানা, অথবা সদ্য চেনা, অজানা অচেনা নদী ঝোরা পার হয়ে চলেছি। চেল নদী পেরিয়ে রানিচেরা চা-বাগিচা।
চেল নদীর অপরূপ শোভা এখানে। চেল নদীকুলে পাপরখেতি নামের এক সুন্দর স্থান আছে। বাঁ-হাতি গরুবাথান পেরিয়ে আরও একটা ছোট্ট জনপদ ডামডিম। কাছেই টি ট্যুরিজমের নতুন ঠিকানা ফাগু ও সামবিয়ং। শঙ্খিঝোরা, সুখাঝোরা ইত্যাদি বিবিধ ঝোরা পেরিয়ে রাজা টি-এস্টেট। মাঝেমাঝেই চোখে পড়ছে চা-বাগানে মহিলা শ্রমিকদের পিঠে লাগানো বেতের ঝুড়িতে নিপুণ হাতে, ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার ব্যস্ততা।
(ক্রমশ…)