টেবিলে ব্যাগটা রাখবার কিছু সময় পরেই নিজের বোতলটা বের করে আধ বোতল জল শেষ করে দিলেন অলোকা ম্যাডাম। এমনটা যে রোজ করেন তা নয়, তবে আজকে লিফটের কী একটা অসুবিধা হয়েছে, দু’তলা থেকে এই চারতলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে হল। বয়স হচ্ছে, এবার একটু বেশিই হাঁপ লাগছে। কয়েকদিনের মধ্যে একবার ডাক্তার বোসের কাছে যেতে হবে। মেয়ের কথা ভেবে সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই অলোকা ম্যাডাম নিজের চেয়ারে বসে চারদিকটা একবার দেখে নিলেন। অনেক টেবিলই এখন ফাঁকা। চেয়ার থেকে উঠে গোবিন্দ এসেছে কিনা খোঁজ করলেন। না, ওই মহাশয়েরও পাত্তা নেই, অন্য কোথাও ফাইফরমাশ খাটতেও যেতে পারে। ম্যাডাম আস্তে আস্তে নিজেই বোতলে জল ভরতে গেলেন। চেয়ারের কাছে আসতে যাবেন, এমন সময় অন্য প্রান্ত থেকে কাবেরি হাত নাড়ার সাথে বেশ জোরেই চিৎকার করে উঠল— ‘অলোকাদি, আসছি, দারুণ খবর আছে।’
মেয়েটা কয়েক বছর হল এখানে জয়েন করেছে, আগে অন্য কোনও এক ডিপার্টমেন্টে ছিল। বেশ চনমনে, এর মধ্যে দুটো ডাইভোর্স হয়ে গেছে, এখন একটা ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে তৃতীয় বিয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছে। কারওর খাতির করে না, এক্কেবারে মুখের সামনে বলে দেয়। এই জন্যেই অফিসের আর কেউ তাকে ঘাঁটায় না। তবে অলোকা ম্যাডামের সাথে বেশ ভালোই সম্পর্ক, কয়েকবার তার বাড়িতেও গেছে। ঘটনাটার পরে…।
—তোমার পাশে বসে বলতে হবে, দারুণ খবর।
কথাগুলো শেষ করবার আগেই অলোকাদির টেবিলের পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে যায় সে। তারপর চারদিকটা দেখে। বলে, “কিছু কি শুনেছো?”
—কী ব্যাপারে বলতো?
—এই সুমনার ব্যাপারে?
অলোকা ম্যাডাম বেশ অবাক হন, ‘সুমনা মানে নীচের তলায় ডেসপ্যাচে বসে, গড়িয়ার দিক থেকে আসে!”
—হ্যাঁ গো।
—ওরও তো স্বামীর চাকরি, বেচারি, খুব অল্পদিনই বিয়ে হয়েছিল।
—হ্যাঁ। এখন একেবারে ফেমাস হয়ে গেছে, কাল একটা টিভিতে ওর ইন্টারভিউ দেখিয়েছে।
—ইন্টারভিউ! কেন?
—আরে সেটাই তো বলছি।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। বাবা মা আর তাদের একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা, আদরের ঘুড়ি, এই তিনজনের সুখের সংসার ছিল। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, টাকার প্রাচুর্য না থাকলেও বেশ ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছিল। মেয়ে ইংরাজি মিডিয়ামে না পড়লেও শহরের নামি সরকারি স্কুলেই পড়ত। একদিন রাতে খেয়ে উঠে বাবার বুকে ব্যথা, হাসপাতালে নিয়ে যাবার রাস্তাতেই শেষ। তারপরেই মায়ের আরম্ভ হল আরেক যুদ্ধ, সেটা এখনও চলছে। মাঝখানে এখন আরেকটা লড়াইও এসে জুটেছে।
বাস থেকে নেমে টোটোতে সুমনার বাড়ি আসার রাস্তায় এই সব কথাগুলো অলোকা ম্যাডামের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করেছিল। ‘মেয়েদের ভেতর একটা আলাদা শক্তি থাকে, যে-কোনও স্থানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে। যারা পারে না তাদের কপালে চরম দুঃখ নেমে আসে।’ কথাগুলো বারান্দায় বসে বসে ঠাকুমা প্রায়ই বলত। এখন এই সব কথা কাউকে বললে উলটোপালটা কথা শোনাবে। ঘুড়ির এই রকম অবস্থা ছিল, এই সব কথা বললে রেগে উঠত।
টোটোতেই ফোনটা রিং হয়। অলোকা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই দ্যাখেন ‘সুমনা কলিং’। ফোনটা রিসিভ করতেই লোকেশন বলে দেয়।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই অলোকা খুব অবাক হয়ে যান। দরজাটা সুমনাই খুলেছে। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে আর কেউ থাকে না?’
—আর কে থাকবে? অশোক মারা যাবার পরে মা কয়েক মাস ছিল, তারপর থেকে আমি একা। শোকটা নিতে পারল না, প্রথমে বাবা তারপর মা— ওই ছয় মাসের গ্যাপ।
—কিছু অসুবিধা হলে?
এই কমপ্লেক্সে একটা প্রাইমারি হেল্থ সার্ভিস আছে, যে ডাক্তারবাবুর আন্ডারে আছি, তার ফোন নম্বরও নিয়ে রেখেছি। –কিন্তু আর কয়েকদিন পরে তো…
—তখন একটা আয়াকে রেখে দেব। কথাবার্তা বলা আছে।
—তোমার তো এখন বেড রেস্ট দরকার?
—ওভুল্যেশনের পরে পজিটিভ হল, দু’সপ্তাহ একটু সাবধানে থাকতে বলেছিল। আমি তিন সপ্তাহ বেডরেস্ট নিয়েছি। আমার আবার একটা প্রোজেস্টেরণ হরমোন ট্রিটমেন্ট হল, অশোক বেঁচে থাকতে একটা মিসক্যারেজ হয়েছিল। তাই ডাক্তারবাবু আর রিস্ক নেননি। এখন তো মাঝেমাঝেই ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে। সিক্স উইকে একটা ইউএসব্জি আছে, এইট উইকে একটা ইউএসজি আছে। তারপর আস্তে আস্তে এনটি স্ক্যান, ডবল মার্কার — এই সব চলতেই থাকবে।
—বাবা, এত কিছু! আমাদের সময় এত সব ছিল না।
—এখন ডাক্তাররা যেভাবে ভাবছেন।
—আমি কাবেরির কাছে তোমার কথা পরশুই জানতে পারি। এই রকম একটা ঘটনা যে এই দেশে হতে পারে এটাই তো ভাবতে পারছি না। অলোকা ম্যাডামের কথাগুলো শুনে সুমনা একটু হেসে ওঠে।
—কাবেরিদি-ও জানতে পারত না, নেহাত সে দিন টিভিতে আমার সাক্ষাৎকারটা দেখতে পেয়ে গেছিল, তারপরেই ফোন করে। নাহলে আমি অফিসেও কিছু বলিনি। সবাই জানে শরীর খারাপ।
—তোমার সাহস আছে, আগে তোমার সাথে সেরকম কথা হয়নি। কাবেরি তোমার কথা বলতেই প্রথমে খুব অবাক লাগছিল। আমার পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা আইভিএফ ট্রাই করলেন। কিন্তু সাকসেস হল না।
—সাকসেস রেট তো খুব কম, সারা দেশে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। বয়স কম হলে মেরে কেটে চল্লিশ। তাও তো এখন অনেকটা বেড়েছে। প্রসেসটাও তো খুব জটিল, সম্ভবত চারটে স্টেপ আছে। কিছু সময় থেমে অলোকা বললেন, ‘আচ্ছা তুমি তো আবার বিয়ে করলেই পারতে।’
(ক্রমশ…)