কতদিন খোলা ছাদের তলায় এভাবে শুয়ে থাকেনি সে। বারান্দা বা ঘরের জানলা দিয়ে রাতের আকাশ যতটুকু দেখা যায় তাতে মন ভরে না। ঝুনুদি কিছুটা জোর করেই ছাদে নিয়ে এসেছিল। দুই বোনে নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে শুয়ে শুয়ে ছোটোবেলার দিনগুলোতে হারিয়ে গেল। ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছিল। সোনালির ভালো লাগছিল খুব। ভাগ্যিস ঝুনুদি জোর করে তার এখানে চলে এসেছে, তাই হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু তার জীবনে আবার ফিরে এল।
ঝুনুদি অনেকক্ষণ কী যেন বলার জন্য উশখুশ করছিল, টের পেয়েও সোনালি চুপ করেছিল। একসময় ঝুনুদি জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘পার্থর খবরটা শুনেছিস তো?’ বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে সোনালির। পার্থদা? খুব একটা স্মৃতি নেই তাকে ঘিরে, শুধু একটিমাত্র ঘটনার জন্যই আজও মানুষটার নাম মনে আসলে বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে।
—সে তো বাইরে কোথাও থাকে, আমেরিকার কোনও অঞ্চলে।
—থাকত, ওদেশের পাট চুকিয়ে ফিরে এসেছে। ওদের পুরোনো বাড়িটা সংস্কার করে ওখানেই থাকছে। বিশাল ফার্ম হাউস করেছে। সবজি, ডিম, দুধ বিক্রি করার পরও যা থাকে, গরিব লোকজনের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। দেখা হয়েছিল কিছুদিন আগে। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। আর তোকে একটা কথা জানাতে চায়। ফোন নাম্বার নিবি সনু? সোনালি এই মধ্য চল্লিশেও একটু যেন কেঁপে যায়। কী কথা জানাতে চায়? এতকাল পরে? কিছুটা সজাগ হয়েই যেন নিজেকে কঠিন আবরণে মুড়ে নেয় সে।
—পার্থদা যে ফিরে এলেন, ওঁর বউ, ছেলেমেয়েরাও আমাদের মুর্শিদাবাদের গ্রামে রয়ে গেল?
সোনালিকে অবাক করে দিয়ে ঝুনুদি বলে উঠল, “দূর ও দেশে আবার বিয়ে, সংসার! ওই আমেরিকান মহিলা গুচ্ছের টাকার বিনিময়ে কবেই ডিভোর্স নিয়ে কেটে পড়েছে। আর ছেলেমেয়ে কোথায় পাবি? পার্থ নিঃসন্তান।”
সোনালি চোখ বন্ধ করে হারিয়ে যাচ্ছিল কিশোরিবেলার দিনগুলোতে। এমনি এক তারাভরা আকাশের নীচে… পার্থদা এতকাল পরে কী বলতে চায় তাকে!
( দুই )
তৃষা আর ঝরনামাসি ফোন করেই এল। ‘অন্নপ্রাশনে তুই ফাঁকি দিয়েছিলি, পাঁচ বছরের জন্মদিনে কিন্তু আসতেই হবে।” ঝরনামাসির কথায় সোনালি মৃদু মৃদু হাসছিল। তারপর কার্ডে ডেটটা দেখে বলল, ‘এবারেও যাওয়া হবে না, ওই সময়টা বেড়াতে যাচ্ছি।’
ঝরনামাসির মুখে অসন্তোষ, ‘তুই কেন আত্মীয়স্বজনকে এড়িয়ে যাস বুঝি না? সবাই এক কথা জিজ্ঞেস করে, তোর অস্বস্তি হয়। তা সময় থাকতে দেখেশুনে একটা বিয়ে করলেই পারতিস, তাহলে এমন করে মুখ লুকিয়ে ঘুরতে হতো না, এখন তো পস্তাচ্ছিস। মেয়ে মানুষের এত গুমোর ভালো না।
–আহ মা! চুপ করো না। দিদিভাই তো আর তিতলির বার্থডে’র খবর আগে জানত না। তারপর সোনালির কান বাঁচিয়ে বলে, বুঝতেই পারছ তো মা, আমরা ভালো আছি সহ্য করতে পারে না। আমাদের ভরভরন্ত সংসারটা দেখলে হিংসায় জ্বলে মরে।
কিচেনে কফি বানাতে বানাতে কথাটা সোনালির কানে ঠিকই গেল। কফির কাপ তুলে দিতে দিতে সোনালি বলল, ‘রাগ করছ কেন? আমি এর মধ্যেই একদিন তিতলিকে আশীর্বাদ করে আসব। ঢাকুরিয়া আর পাটুলি কতটুকুই বা রাস্তা!”
তৃষার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। দিদিভাইয়ের আশীর্বাদ মানে তো মোটা অঙ্কের উপহার। কিন্তু একটু আপশোশ থেকেই গেল, নিজের সংসারের উপচে পড়া সুখটা দেখাতে পারবে না বলে।
সোনালিকে এই সমস্ত কথাগুলো আর ছোঁয় না। ও এসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওরা চলে যাবার পর বারান্দায় এসে বসল। শখ করে একটা দোলনা বসিয়েছে কিছুদিন হল, তাতেই বসল। মনটা নির্ভার হয়ে গেল পলকেই। সত্যি তো ওরা কত ভালো আছে।
জয়া সেদিন বলছিল, “জানিস সোনালি, জ্বরে দু’দিন কাতরালাম, অর্ণব অফিস টুরে। তাথৈ কী যত্নটাই না আমার করেছে। ওষুধ এনে খাওয়ানো, দুধ গরম করে মুখের সামনে ধরা থেকে মাথা ধুইয়ে দেওয়া সব এইটুকু মেয়ে করেছে। কতই বা বয়স ওর বল? এই তো ক্লাস এইটে উঠল।’
সত্যি জয়া ভাগ্যবতী। সোনালি জানে সে জ্বরে কাতরালেও মুখের সামনে জল ধরার কেউ নেই। সুস্থ থাকলে তো দরজা খুলে দেবে, তবে তো কাজের মেয়েরা আসবে!
তৃষাও খুব ভালো আছে। পিনাকির সঙ্গে আজ সিঙ্গাপুর, কাল শ্রীলঙ্কা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর সব স্মার্ট ড্রেস, ব্রান্ডেড সানগ্লাস পরে ছবি আপলোড করে! সত্যি ওরা তো ভালো আছে। সোনালির বেড়ানোর এত শখ। কিন্তু সঙ্গী কই? সবাই ফ্যামিলি নিয়ে আনন্দ করবে তার মাঝে সোনালিকে নেবে কেন? তাই সে ট্রাভেল কোম্পানির সঙ্গে একাই বেরিয়ে পড়ে। একা দেখে লোকজনের সেই একঘেয়েমি কৌতূহল, বেড়ানোর আনন্দটাই অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়। তবু জোর করেই প্রতি বছর একটা লং-টুর আর দুটো শর্ট-টুর করে ফেলে।
ঝুনুদির ফোন আসে, এটা ওটা কত কথাই কলকল করে বলে যায়। ‘আর বলিস না, আমার হয়েছে মরণ। ছোটো ছেলে আর বড়ো ছেলের মধ্যে কম্পিটিশান চলছে কে মাকে কতদিন নিজের কাছে রাখতে পারে। আমার তো নিজের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। এত খোলামেলা বাড়ি ছেড়ে দেশলাই বক্সের মতো ফ্ল্যাটবাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে রে। সামনের সপ্তাহেই ছোটোর কাছে যেতে হবে শিলিগুড়ি। তাই বড়োর কী রাগ! আগের বার তো বেশিদিন থাকতেই পারলাম না।”
হ্যাঁ সোনালির মনে আছে তার কাছেই ক’টা দিন কাটিয়ে গিয়েছিল ঝুনুদি। ছেলে বলেছিল, এভাবে একা তোমাকে রেখে যেতে পারি নাকি? হয় আমাদের সঙ্গে চলো না হয় কোথাও থেকে যাও। তারপর এর ওর কাছে সোনালির ঠিকানা জোগাড় করে ঝুনুদিকে ক্যাবে তুলে দিয়েছিল। জীবন সত্যি মধুর। সোনালি এইসব ছোটো ছোটো সুখ থেকে বঞ্চিত। যাহ এসব কী ভাবছে সে! বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে কি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করল?
—এই শোন যে জন্য ফোন করেছিলাম, পার্থ তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। তুই তো ফোন করিসনি। তোর নাম্বারটা আমি কিন্তু দিয়ে দিয়েছি।
সোনালির এবার খুব রাগ হয়। ঝুনুদি একটু বেশিই তার উপর দখলদারি শুরু করে দিয়েছে। পার্থদার সঙ্গে সে আদৌ যোগাযোগ করতে চায় কিনা সেটা আগে বুঝুক। বিরক্তিতে ফোনটা কেটে দেয়।
এতকাল পরে কী কথা থাকতে পারে তার? সেদিন তো তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি, উলটে ঝুনুদির জেরার মুখে বলেছিল, “অন্ধকারে আমি বুঝতে পারিনি ঝুনু। সনু এমন ভাবে হাত নেড়ে ডাকল!”
ঘৃণায় ঝুনুদির মুখটা কুঁকড়ে গিয়েছিল, এক দলা থুতু ফেলে হিস হিস করে বলেছিল, “তুই নাকি এ বংশের সবথেকে সেরা মেয়ে, সবার থেকে এগিয়ে আছিস রূপে, পড়াশোনায়। তোর মায়ের তো তোকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই, সেই তুই এত খারাপ?’
(ক্র্মশ…)