অনন্যার ঠোঁটে মায়ের করা কেকের স্বাদ তখনও লেগে। চেটেপুটে নেয় প্রীতম, ঘামতে থাকে। অনন্যার গলায়, ঘাড়ে কি সুন্দর মাদকতাময় মেয়েলি গন্ধ। এই অনন্যা ওর, শুধু ওর নিজের, ওর সবচেয়ে ভালোবাসার জন। তার সঙ্গে শরীরী প্রেমে অন্যায় কি আছে? কোনও বাঁধন নেই, পাগলের মতো শুধু চুমোয় চুমোয় দুজনে দুজনকে অস্থির করে দেয়। প্রীতম ওর মুখটা প্রাণপণে নামিয়ে আনতে চাইল নীচে, আরও নীচে। সেখানে মুক্তোঝিনুক আছে, তার রহস্য ওকে আজ ভেদ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে নয়, প্রীতম শুধু দামাল ভালোবাসায় অনন্যার আগলগুলো সরিয়ে দিতে চাইছিল। অনন্যা চেপে ধরল প্রীতমের মুখ, ওর সম্বিৎ ফিরল। অনন্যা ওকে বাধা দিচ্ছে আরও নীচে নামতে!
না, অনন্যাকে কোনও জোর সে করতে পারবে না। পৌরুষের আত্মাভিমান ওকে বাধা দিল। অনন্যা ওর প্রেমিকা, ওর কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছে নিজেকে, তার ওপর কি জোর খাটানো যায়? প্রেমিকা তো আর কোনও ভোগ-লালসার পসরা নয়। যা হবে দুজনের পারস্পরিক সহমতেই হবে। আর একটু এদিক ওদিক হলেই একটা বড়ো ভুল করে ফেলছিল, যার কোনও ক্ষমা হতো না জীবনে। কত ছোটো হয়ে যেত ও। প্রীতম পরিষ্কার বুঝতে পারল, অনন্যা এখন প্রস্তুত নয়, অনন্যা থামতে চাইছে। প্রীতম সেই ইচ্ছাকে সম্মান দেয়। আর তাই তখনই এক পারস্পরিক ভরসা, বিশ্বাস আর মরমি ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে যায় দুজনে, একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে।
সময় চলে গেছে অনেকটা, অবশেষে ওদের সম্বিৎ ফিরল। এবার ফিরতে হবে, প্রীতম অনন্যাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিল। অনন্যার যেন তখনই যাবার ইচ্ছে ছিল না, কিছুটা বাধ্য হয়েই দুজনে দুজনকে বিদায় দিল। দরজা খুলে নিমেষেই সিঁড়ি দিয়ে হারিয়ে গেল অনন্যা। কেউ দেখেনি, নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা বন্ধ করল প্রীতম।
এই ঘটনার পনেরো বছর পরের কথা। প্রীতম আজ বড়ো একটা সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে উঁচু পোস্টে চাকরি করে। বিবাহিত কিন্তু ঠিক সুখী নয়। একটা মেয়েও আছে কিন্তু প্রেম নেই ওর জীবনে। অনন্যার সঙ্গে প্রেমটা ভেঙে গেছিল অনেকদিন আগেই। অনন্যা বাধ্য হয়েই খুঁজে নিয়েছিল অন্য সঙ্গী, নিশ্চিন্ত বিবাহিত জীবন। কিছু করার ছিল না প্রীতমেরও। তখনও ও বেকার। বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন, সংসারে অনটন। তারপর জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে, জীবন গড়িয়েছে নিজের নিয়মে। দুজনে দুজনকে হয়তো ভুলেও গিয়েছিল সেই ফাঁকে। কিন্তু ক’দিন আগে, হঠাৎই ফেসবুকে দুজনের আবার যোগাযোগ হয়ে গেল। খুঁজে খুঁজে প্রীতমই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল অনন্যাকে।
অনন্যার চেহারা ভারী হয়েছে কিছুটা কিন্তু এখনও আকর্ষণীয়। প্রীতমেরও চুল একটু হালকা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশ বেড়েছে, কিন্তু মনটা রয়ে গেছে আগের মতোই সতেজ, প্রেমিক, যৌবনময়। ফেসবুকে চ্যাটিং বা ভিডিওকলে বেশ ক’বার দুজনের কথা হয়েছে। অনন্যার একটি ছেলে, স্বামী চাকরি করে কী একটা কারখানায়। অনন্যাকে দেখেই পুরোনো স্মৃতি আবার জেগে উঠল প্রীতমের। রোমান্স নয়, এখন ওর অন্য একটা শারীরিক খিদে জেগে উঠল অনন্যার প্রতি, যৌনলালসা। সেদিনের মতো নিষ্কাম প্রেম আজ আর নেই, শুধু জৈবিক চাহিদাই এখন বড়ো হয়ে উঠেছে। সময় পালটে গেছে, বদলে গেছে দুজনেই।
আজ পনেরো বছর পরে, যখন আবার অনন্যাকে প্রস্তাবটা দিল প্রীতম, অনন্যা কিন্তু প্রথমেই না বলে দিয়েছিল। প্রীতমের সঙ্গে আর সে দেখা করতে চায় না, ফ্ল্যাটে আসা তো দূরের কথা। কিন্তু কী করবে প্রীতম? ও আজ নিঃসঙ্গ। মানসীর সঙ্গে ওর বনেনি, তাই মেয়েকে নিয়ে মানসী প্রায়ই বাপের বাড়িতে আলাদা থাকে, মিউচুয়াল সেপারেশনেরও কথাবার্তা চলছে।
মা-ও মারা গিয়েছেন বছর দুই হল। ফ্ল্যাটটাতে প্রীতম এখন একাই থাকে। শুধু অনন্যা যদি আর একবার আসত! কিন্তু আজ প্রীতমের মনে বিন্দুমাত্র প্রেম নেই, আছে শুধু ভোগবাসনা। বিবাহিত জীবনে ও সুখ পায়নি, অনন্যাকে পেলে এবারে বিছানায় নিয়ে গিয়ে তুলবে, শয্যাসঙ্গিনী বানাবে। পনেরো বছর আগের সেই দিনটায়, বোকার মতো ও যা পারেনি, আজ সুদে-আসলে তা উশুল করে শোধ তুলবে।
—কবে দেখা হবে আমাদের?
—কেন, দেখা করে কী হবে? এই তো ফোনে বেশ কথা হচ্ছে।
—না গো, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
—সে কী গো! ভিডিও কলে তো রোজই দেখতে পাচ্ছ।
—না না সেরকম নয়, সামনাসামনি।
—কী দরকার? তার চেয়ে এই ভালো।
—কী বলছ! এত বছর পর দু’জনের যোগাযোগ হল, আর দেখা করব না! বিশেষ করে দু’জনেই যখন এত কাছে থাকি।
—ঠিক আছে, চলে এসো না বাসস্টপে। ওখানেই দেখা হয়ে যাবে।
—না, না, কী বলছ। সবাই দেখে ফেলবে যে। শেষে কে কী ভাববে!
—কী আবার ভাববে? কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না নাকি?
—কেউ যদি সন্দেহ করে! তোমার হাজব্যান্ড বা আমার বউ জেনে গেলে সমস্যা হবে, বুঝলে?
—তাহলে?
—তাহলে আবার কী? আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। তুমি তো চেনো।
—না, না বাবা, ফ্ল্যাটে যেতে ভয় করছে।
—ভয়! আমি কি বাঘ না ভাল্লুক, যে তোমাকে খেয়ে ফেলব?
—না তা নয়…
—তবে আবার কী? চলে এসো। প্রাণ খুলে গল্প করব কতদিন পর।
—কিন্তু…
—কোনও কিন্তু নয়। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
—তা কেন হবে? আসলে আমার না ঠিক যেতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে চলো না, কফি হাউসে বসে আড্ডা মারি।
—কফি হাউস? অতদূর? কেউ দেখে ফেললে?
—তাহলে ছাড়ো। দেখা করার দরকার নেই।
—কেন? প্লিজ, একবার এসোই না। ফ্ল্যাটটা দারুণ সাজিয়েছি, তুমি দেখবে না?
—তাই নাকি? দেখি, তাহলে যাব একদিন।
—ঠিক তো? কবে আসবে বলো।
—বলে দেব। কিন্তু আমার দিকটাও দেখো।
আসলে প্রীতমকে দেখতে ইচ্ছে করছিল অনন্যারও। কিন্তু ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, প্রীতম পালটে গেছে। মেয়েরা অনেক কিছু দূর থেকেও বুঝতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হল অনন্যাকে, প্রীতমের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের কাছে। প্রীতমকে ও ভালো করেই চেনে, আপনার জন মনে করে, এখনও সেদিনের মতোই ভালোবাসে। প্রীতম যে বড়ো ভরসার জন ছিল, ভালোবাসার জন ছিল। এখন অবশ্য অনন্যা আর্থিক ভাবে একটু দুর্বল, ওর স্বামী তপন সেরকম বড়ো চাকরি করে না। কষ্টেসৃষ্টেই চলে ওদের। বেশিরভাগ সময় ও ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকে।
প্রীতম কিন্তু অনন্যার শেষ কথাটার মানেটা এখনও বুঝতে পারেনি। কী বলতে চাইছে অনন্যা ওকে? টাকা পয়সার কথা। আর্থিক সাহায্য চায়? ও কি প্রীতমের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে? তাই শরীরের বিনিময়ে কিছু আদায় করে নিতে চায়? প্রীতমের একটু খটকা লাগে।
অবশেষে একদিন অনন্যা প্রীতমের ফ্ল্যাটে আসতে রাজি হয়ে গেল। মোবাইলে কথা হয়ে গেল দুজনের এইমাত্র। অনন্যা এখনই আসছে। ফ্ল্যাটের ভিতর একা প্রীতম। ওর বুকে আজও সেই প্রথম দিনটার মতোই হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল। একটা জিন্স আর টি শার্টে এখন ওকে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছে। সেদিনকার মতো নার্ভাস আর ও নয়। ফ্ল্যাটটাও ঝাঁ চকচকে করে সাজিয়েছে। দামি গ্যাজেট, ফার্নিচার, ইমপোর্টেড শোপিস, দেয়াল জোড়া অয়েলপেন্টিং, লেটেস্ট ইন্টিরিয়র ওর আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দেয়।
প্রীতম ফ্রিজ থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে ডাইনিং টেবিলে সাজায়, সঙ্গে দুটো গেলাস। উত্তেজনায় ও দু’পেগ মেরেও দেয়। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে অনন্যার জন্য। সেই পাঁচ মিনিটের রাস্তা, সেই ফ্ল্যাট, সেই দুজন। মাঝে শুধু কেটে গেছে পনেরোটা বছর। সেদিনের ভুল আর ও করবে না, দরকার হলে জোর করবে! আজ ওর নেশা চেপে গেছে, ক্লাবড্রাগ ড্রিংকস-এ মেশাতে কতক্ষণ?
ওর সাজানো ফ্ল্যাটে আজ সবকিছুই আছে, শুধু আর সেখানে কোনও কবিতার বই নেই, সেসব কোথায় চলে গেছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রতিযোগিতা, দাম্পত্য কলহ আর স্বার্থান্ধতায় সেসব কোথায় মুখ লুকিয়েছে বা হয়তো খবরের কাগজের সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছে। সেসব যাক, আজ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অনন্যা কি আসছে? প্রীতম উত্তেজনায় ফুটতে থাকে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দগুলো ওকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। কলিংবেল বাজে। ছক সাজাতে সাজাতেই, সপ্রতিভ প্রীতম তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই চমক। দেখতে পায় একটি শিশুর হাস্যময়, আলোকিত মুখ। তার আভা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে। তার পেছনে ঝাপসা মুখ, কপালে টিপ, মুখে হাসি— না কোনও মেয়ে নয়, কোন পরস্ত্রী বা প্রেমিকা নয়, দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মা। প্রীতমের মনে পড়ল ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টাঙানো যামিনী রায়ের আঁকা ছবিটার কথা— ক্যাপশন– ‘মা ও শিশু’।
(সমাপ্ত)