সমর্পণ ও দীপেন চুপচাপ সব মন দিয়ে শোনে। অনেকক্ষণ কোনও কথা বলে না।
উত্তম বলে, ‘মারের বদলা পালটা মার দিতে না পারলে হবে না। তাই এভাবে একটা স্ট্রোক দিয়ে দেখতে পারো। তবে সব কিছুর জন্য তোমাকে কিন্তু প্রস্তুত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।’
—কিন্তু লেডি অ্যাডভোকেটের কথা বললে কেন? জানতে চায় সমৰ্পণ।
—দীপেনের সঙ্গে একজন মহিলা থাকলে রঞ্জিতের স্ত্রী ওর বিরুদ্ধে অন্য কোনও চার্জ সহজে আনতে পারবে না। বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই আমি কীসের আশঙ্কা করছি?
—আচ্ছা, আমি কি প্রাণে মারা যেতে পারি। মানে আমাকে কি খুন করে ফেলতে পারে ওরা। দীপেন থেমে থেমে প্রশ্ন করে।
—ত্রিকোণ প্রেমে যে-কোনও একজনের মৃত্যু তো প্রায় রোজই খবরে আসে। এতে আশ্চর্যের বিশেষ কিছু নেই।
দীপেনের চোখ-মুখ কালো হয়ে যায়। আরও খানিক সময় কথাবার্তা বলে অবশেষে ওরা কফিশপ ছেড়ে যে-যার বাড়ির দিকে রওনা হয়।
চার মাস পরের ঘটনা। মিটিং-এর দিনই দীপেন ওর স্ত্রী এবং রঞ্জিতের মোবাইল নাম্বার উত্তমকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিয়েছিল। কিন্তু তারপর হঠাৎই আশ্চর্যরকম চুপ করে যায় ও। সমর্পণের মর্নিং উইশ রেগুলার এলেও দীপেন সম্পর্কে কোনও খবরাখবর আসে না। ফলে উত্তমও ব্যাপারটি নিয়ে আর উৎসাহ দেখায় না।
চার মাস পর এক রবিবার উত্তম সমর্পণকে ফোন করে। প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পর উত্তম প্রশ্ন করে, ‘দীপেনের ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী হল?’
—ভারী অদ্ভুত ব্যাপার জানো, জবাব দেয় সমর্পণ। দীপেন ব্যাপারটা নিয়ে আচমকাই একদম কুল হয়ে গেছে। আমি বার দুয়েক ওকে ফোন করেছিলাম, ফোন ধরেনি। পরে দেখলাম ওর নাম্বারে ফোন করলে নাম্বারটা ইনভ্যালিড জানাচ্ছে। বাধ্য হয়ে একদিন রাত ন’টা নাগাদ দেখা করতে গেলাম ওর বাড়ি। ওর স্ত্রী দরজা খুলে দিলে বাইরের ঘরে বসলাম। খানিক পর শুনতে পেলাম ও বেশ জোরে জোরে আমাকে শুনিয়ে স্ত্রীকে বলছে, বলে দাও আমার শরীর খারাপ, আজ দেখা করতে পারব না। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম, সেইসঙ্গে কিছুটা অপমানিতও। ওর স্ত্রী ঘরে এলে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আজ তবে আসি, পরে আসবখন।’
—আশ্চর্য! বলে উত্তম।
—সত্যি সেদিন আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম ওর ব্যবহারে। দীপেন আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করল, আকাশ-পাতাল ভেবেও কিছু বুঝতে পারলাম না! পরদিন ওর স্ত্রী ফোন করে সন্ধ্যাবেলা যেতে বলল।
—তুমি গেলে?
—গেলাম। দীপেন বাড়ি ছিল না। ওর স্ত্রী দরজা খুলে দিলে দেখলাম বসার ঘরে ওর মেয়েও রয়েছে।
তমালিকা বলল, ‘দাদা বসুন। আমি চা করে আনছি।’
বললাম, ‘না না, চা খাওয়ার সময় নেই আমার। তুমি বরং বলো কেন ডেকেছ৷’
তমালিকা বলল, ‘আপনি দীপেনের অনেকদিনের বন্ধু। যতদূর জানি ও আপনার সঙ্গে সব কথাই শেয়ার করে। আমার সম্পর্কে আপনি কী শুনেছেন জানি না। তবে একটা কথা আমি সন্তানের মাথায় হাত রেখে বলছি, আমি নিষ্পাপ। রঞ্জিতের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও শারীরিক সম্পর্ক নেই। এ কথা আমি দীপেনকে বারবার বলেও বিশ্বাস করাতে পারিনি। ইদানীং ও আমার বাপারে খুব উদাসীন হয়ে পড়েছিল, বড্ড অবহেলা করত আমাদের। তাই রঞ্জিতের সঙ্গে একটু আন্তরিকতা দেখাতে হয়েছিল আমাকে। পঞ্চাশ বছর বয়সে সংসার নষ্ট করে আমি যাব পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে, এত অবিবেচক বলে আমাকে মনে হয় আপনার?’
—তুমি কী জবাব দিলে। জানতে চায় উত্তম।
—কী আর বলব, কিছুক্ষণ নানা কথা বলে চা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। সবকিছু আমার যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল। এর ঠিক তিনদিন পর হঠাৎ দীপেন ফোন করে বলল, ‘আমার বাড়িতে আমার স্ত্রীর সঙ্গে গোপনে আড্ডা দিতে আসছ শুনলাম?’
—গোপনে হলে তুমি কি জানতে পারতে? যা কিছু কথাবার্তা তোমার মেয়ের সামনেই হয়েছে, সেটা জানো নিশ্চয়ই? আবাক লাগে, দীপেনটা কি শেষ পর্যন্ত মেন্টাল পেশেন্ট হয়ে গেল!
পরক্ষণেই হেসে বলল, ‘আরে ধুস, তোমার সঙ্গে একটু ইয়ারকি করলাম। শোনো বন্ধু, তোমার কাছে বেশ কয়েকবার আবদার করেছিলাম আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে। তুমি হেসে এড়িয়ে গেছ। বলেছ, উপযুক্ত মালমশলা পেলে সময় মতোন লিখব। আশা করি তোমার হাতে এতদিনে আমার বিষয়ে যথেষ্ট উপকরণ এসে গেছে। নাও এবার কিছু একটা লিখে ফেলো দেখি। আমাকে অমরত্ব দিয়ে দাও।’
—তারপর?
তারপর সামান্য হেসে বলল, ‘কেমন মজা করলাম একবার বলো।’
—আসলে দীপেনের ব্যাপারটা আমি এত সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম যে, তোমাকে একরকম জোর করেই এ ব্যাপারে টেনে এনেছিলাম। আমি খুবই লজ্জিত উত্তম। তুমি ব্যস্ত মানুষ। বন্ধুর বিপদ শুনে তুমি ছুটে এসেছিলে, আমার অনুরোধ ফেলতে পারোনি। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।
—আরে, ঠিক আছে। বন্ধুদের মধ্যে একটু আধটু মজা চলতেই পারে। ও নিয়ে তুমি ভেবো না। আই ডোন্ট মাইন্ড। পরে কথা হবে, বাই।
—বাই, বলে সমর্পণ।
—ও ভালো কথা, দীপেনের উপর গল্পটা কি লিখলে?
সমর্পণ হেসে বলে, ‘হ্যাঁ তা বলতে পারো। ভেবে দেখলাম, স্বপ্নপূরণের জন্য কম তো করল না ছেলেটা। গল্পটা লেখা হয়ে গেছে। একটা পপুলার লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে পাঠাব ভাবছি। দেখা যাক, প্রকাশিত হলে জানাব তোমাকে।’
—আচ্ছা জানিও, বাই, বলে ফোন কাটে উত্তম। তারপর জানলা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকায়। পুনরায় ভাবতে বসে, গোটা বিষয়টা মজা? দীপেন মজা করল? এ পৃথিবীতে কে যে কার সঙ্গে কীভাবে মজা করে চলেছে নিরন্তর, কেই-বা তা জানতে পারে। কারণ, তিনজনের অডিও রেকর্ডেড সংলাপ এখনও ওর হাতের মুঠোফোনে।
(সমাপ্ত)