দুই শিশুর মধ্যে ঝগড়া-মারামারিতে মৃত এক।’ –বিরল হলেও, এমন ঘটনা মাঝেমধ্যে উঠে আসে খবরের শিরোনামে। আমরা শিহরিত হই। ভয়ে নিজের সন্তানকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। কিছুদিন এই নিয়ে চর্চা চলে। কিন্তু, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের রাস্তা খোঁজেন খুব কম বাবা-মা। তাই, সমস্যার শিকড় উৎপাটিত হয় না। আবারও কোথাও ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।

এই বিষয়ে মা-বাবাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই ওদের ঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। ওরা তো আসলে কাদামাটির মতো। যেমন গড়বেন, তেমনই গড়ে উঠবে। আর এই গড়ার কাজটা করতে হবে একেবারে ভ্রুণ অবস্থা থেকে। কীভাবে? চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, মাতৃগর্ভে ভ্রূণ থেকে ধীরে ধীরে যখন শরীর তৈরি হয়, তখনও কিন্তু নানারকম প্রভাব পড়ে শিশুর মস্তিষ্কে। ওইসময় মা-কে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।

হবু সন্তানের জন্য মা-কে যেমন পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়, হাঁটাচলা কিংবা উপযুক্ত ব্যায়াম করতে হয় কিংবা পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই মানসিক শাস্তিও বজায় রাখতে হয়। কোনওরকম উত্তেজনা, শারীরিক আঘাত, শব্দদূষণ প্রভৃতি এড়িয়ে চলতে হয় মা-কে। শুধু তাই নয়, বিকৃত যৌনসঙ্গমের ফলে তৈরি ভ্রূণেও পড়তে পারে খারাপ প্রভাব। এর ফলে শিশু চঞ্চল মস্তিষ্কের হতে পারে। অবাধ্য এবং মারকুটে হতে পারে বোধবুদ্ধির অভাবে।

জন্মানোর পরও শিশুকে সঠিক আদরযত্নে মানুষ করতে হবে। ভালোবাসা দিতে হবে। শিশু যখন বোধবুদ্ধি অর্জন করবে, তখন তাকে সবার সঙ্গে মেলামেশা করা শেখাতে হবে, ভাগ করে খাওয়ার অভ্যেসও তৈরি করাতে হবে। এর জন্য সময় পেলে শিশুকে নিয়ে খেলার মাঠে যেতে হবে। সঙ্গে নিয়ে যাবেন খেলার সামগ্রী এবং কিছু খাবার। এর কারণ, ওই খেলার সামগ্রী এবং খাবার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শিখবে আপনার শিশুসন্তান এবং শিশুর বন্ধুরাও ওর থেকে একই ভাবে ভালো কিছু শিখবে।

সাধারণত দেখা যায়, কোনও খেলার জিনিস (যেমন পুতুল, বল ইত্যাদি) নিয়ে কিংবা খাবার নিয়ে মাঝেমধ্যে শিশুদের মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। স্কুলে বেঞ্চ-এ বসা নিয়ে কিংবা ছোটোখাটো পেন-পেনসিল নিয়েও শিশুদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, ঠেলাঠেলিতে মনোমালিন্য কিংবা অনেকসময় হাতাহাতিও শুরু হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকার উচিত, ওদের বুঝিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে দেওয়া। আর যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ বারবার কোনও শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন এবং কন্ট্রোল করতে না পারেন, তাহলে অভিভাবককে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পথ বের করেন। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের থেকে সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণের অভিযোগ পেয়ে ভয় কিংবা দুঃশ্চিন্তায় মাথা খারাপ করা উচিত নয়। বরং, অভিযোগ শোনার পর সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করুন।

প্রথমে দেখুন, সমস্যার বীজ কোথায় লুকিয়ে আছে এবং শুভাকাঙক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজুন। যেমন ধরুন প্রতিদিনই আপনার সন্তান কোনও সহপাঠীর সব টিফিন খেয়ে নিচ্ছে জোর করে, এমন অভিযোগ যদি পান, তাহলে কেন এমন করছে তার কারণ জানার চেষ্টা করুন নিজের সন্তানের মুখ থেকে। যদি দেখেন সহপাঠীর আনা খাবার ওর খুব পছন্দ হওয়ার কারণে খেয়ে নিচ্ছে, তাহলে পরের দিন থেকে আপনার বাচ্চাকেও ওই খাবার দেওয়ার চেষ্টা করুন কিংবা ওকে বোঝান, এরকম করা ঠিক নয়— এতে অন্যরা কষ্ট পাবে। আর এরপরও যদি সমস্যার সমাধান না করতে পারেন, তাহলে মনোবিদের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং করান, ভালো ফল পাবেন।

সামান্য বিষয় নিয়ে যদি শিশুদের মধ্যে ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য হয়, তাহলে এতে বাবা-মায়ের নাক গলানো উচিত নয়। কারণ ওটা সাময়িক সমস্যা। দেখবেন, আবার ওরা সবকিছু ভুলে গিয়ে একসঙ্গে হাসছে খেলছে।

শিশুদের শেখাবেন কী কী করা উচিত আর কী কী করা উচিত নয়। ওদের প্রতিযোগী করে তুলবেন না। ‘তোমাকে প্রথম হতেই হবে’ এটা না শিখিয়ে, ‘তুমি ভালো ফল করার চেষ্টা করবে’ —এমন কথা বলাই ভালো। কারণ প্রতিযোগিতা হিংসার জন্ম দেয়।

শিশুদের মন ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশুন। ওদের অভাব অভিযোগগুলি গুরুত্বের সঙ্গে শুনুন। খারাপ কিছু শিখলে তা যাতে আর না করে, বন্ধুর মতো বোঝান শিশুকে।

কারও প্রতি শিশুর যাতে রাগ, হিংসা এসব তৈরি না হয়, সেই দায়িত্ব নিয়ে কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে বাবা-মা- কে। যেমন—

O শিশুকে সামাজিক করে তুলতে উৎসব-অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ করে দিন।

O প্রতিদিন খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে কিছুটা সময় অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলোর সুযোগ করে দিন।

O কোনও অতিরিক্ত বায়না করলে সরাসরি ‘না’ বলবেন না। আবদার করা থেকে বিরত রাখুন কৌশলে।

O কারও সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করলে, তা প্রথমে বুদ্ধি করে থামান এবং এরকম আর না করলে ওর কোনও প্রিয় জিনিস উপহার দেবেন— এমন প্রস্তাব রাখতে পারেন।

O প্রয়োজনে কলহে জড়িয়ে পড়া দুই শিশুকে পরস্পরের কাছে ‘সরি’ বলান এবং হাত মিলিয়ে দিন।

O শিশুর মন ভালো রাখতে, ওকে মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান।

O বাড়িতে থাকলে অবসর সময়ে ভালো বই পড়ার সুযোগ করে দিন। বিশেষকরে নীতিগল্প পড়তে দিন। এতে শিশু মানবিক হবে, ভালো কিছুও শিখবে।

আজকাল ছেলেমেয়েরা দিনরাতে অনেকটা সময় মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ বিষয়েও সতর্ক থাকুন। কারণ, নানারকম সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দীর্ঘসময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে, মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের। ওরা মেজাজ হারাচ্ছে। ফলে, অনেকসময় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলছে। যা কাম্য নয়। তাছাড়া ছেলে-মেয়েরা মুঠোফোনে কী দেখছে, তাও নজরে রাখা উচিত। কারণ বিভিন্ন সিনেমা কিংবা ধারাবাহিকে হিংসা, প্রতিহিংসা, মারামারি, খুনোখুনি প্রভৃতি দৃশ্যে ভরপুর থাকে। যা দেখলে শিশুদের সুকোমল বৃত্তিগুলি হারিয়ে গিয়ে, ক্ষতিকারক মানসিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শিশুরা যদি কোনও ভুল বা অন্যায় করে, তাহলে কী করা উচিত মা-বাবার?

এর উত্তরে জানাই, দোষারোপ করবেন না। দোষারোপ করলে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। ওকে ভালো খারাপের বিষয়টি বোঝান বন্ধুর মতো। ওদের নিরাপত্তা দেওয়াও মা-বাবা এবং স্কুল-শিক্ষকদের দায়িত্ব। কারণ নিরাপত্তা দিলে আত্মবিশ্বাসী হবে, অন্যদের সঙ্গে হেসে খেলে কাটাবে। ওদের লেখাপড়া, আঁকা, নাচ-গান, বাজনা কিংবা বিভিন্ন কাজের সাফল্যেও প্রশংসা করুন। কারণ প্রশংসা করলে শিশুও অন্যদের সঠিক কাজের মূল্যায়ন করতে শিখবে।

আর শিশুদের সামনে নিজেদের মধ্যে (মা-বাবা) ঝগড়া-মারামারি করবেন না। কারণ শিশুরা যা দেখে, তাই করে অনেকসময়। অতএব আপনার সন্তানকে সুসন্তান করে তোলার জন্য আপনার বোধবুদ্ধি দিয়ে তার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করুন এবং সুশিক্ষা দান করুন। আর প্রয়োজনে কলহে জড়িয়ে পড়া দুই শিশুকে পরস্পরের কাছে ‘সরি’ বলান এবং হাত মিলিয়ে দিন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...