পূর্ব পরিকল্পনা মতো শিবরাত্রির সকালে মানব বড়ো একটা গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে কসবা থেকে শুভ্রাদের নাকতলার বাড়িতে পৌঁছোলো। শুভ্রার শ্বশুর-শাশুড়ি আনন্দের সঙ্গে মানবের বউ-বাচ্চাকে দোতলার নিয়ে গিয়ে হইহুল্লোড়ে মাতলেন। সেদিন বিপ্লব ছুটি পেয়েছিল, তাই সে ডিনার পার্টির আয়োজনের জন্য সকাল থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর সকাল ন’টা নাগাদ একটা ক্যাব বুক করে মানব এবং শুভ্রা অফিসে রওনা দিল। মানব গাড়ি আনতে পারেনি, তাই বিপ্লব ওর গাড়িটা শুভ্রাকে নিয়ে যেতে বলেছিল কিন্তু মানব মানা করল।
ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে কাজ শুরু করল মানব এবং শুভ্রা। কিন্তু আজ ওদের মন উড়ু উড়ু, তাই কাজে মন বসাতে পারছে না দু’জনেই। কারণ আজ ওরা নিজের মতাদর্শ এবং মনের খোরাক মেটানোর জন্য এক নতুন জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে অনীহার কারণে জীবনসঙ্গী এবং পরিবার ছেড়ে পালাতে চাইছে তা নয়, ওদের আবেগী মন অবহেলিত হওয়ার কারণে আজ ওরা নিষ্ঠুর হতে চাইছে। মানব এবং শুভ্রার শরীর এবং মনের চাহিদাও সঠিক ভাবে পূরণ করতে পারেনি ওদের জীবনসঙ্গীরা। শুভ্রার বর বিপ্লব এবং মানবের স্ত্রী সুমিতা দুজনেই শরীর এবং মনের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সামাজিকতাকে। আজ তাই ওদের রেখে, নতুন জীবন শুরু করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে চলেছে মানব এবং শুভ্রা।
কোনও রকমে হাফ-ডে অফিস করে মানব ও শুভ্রা রওনা দিল বোলপুরের উদ্দেশ্যে। ট্রাভেল এজেন্সি থেকে ভাড়া করে একটা গাড়ি নিয়েছে ওরা। এক রাত্রি বোলপুরে কাটিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে, আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকার ইচ্ছে ওদের। ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থাও করে নিয়েছে ওরা। একদিন পর খালি হবে ওই বাড়ি, তাই তার আগে প্রথম রাত্রিটা বাইরে কাটানোর ইচ্ছে পোষণ করেছে দু’জনে।
এ-ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবারের কেউ যাতে অযথা খোঁজাখুঁজি না করে, তাই বোলপুরে পৌঁছে সত্যিটা জানিয়ে দেবে।
এর মধ্যে মানব ও শুভ্রার অন্য একটা মতলবও ছিল। ওরা চেয়েছে, বিপ্লব এবং সুমিতা যেহেতু প্রায় একই মানসিকতার, তাই যখন ওরা সত্যিটা জানবে, তখন অসহায়তা কাটাতে হয়তো পরস্পরের অবলম্বন হয়ে উঠবে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সবসময় তা বোধহয় বাস্তবায়িত হয় না। মানব-শুভ্রার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল।
হাইওয়ে ধরে ঠিকঠাক ছুটে চলেছিল ওদের গাড়িটা। কিন্তু বিপত্তি ঘটল বোলপুরের রাস্তায় ঢোকার পর। রাস্তার বাঁকে শুয়েছিল একটা ষাঁড়। আচমকা সামনে এসে যাওয়ায় গাড়ির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল একটা বড়ো গাছে। দুমড়ে মুচড়ে গেল গাড়িটা। চালক প্রাণে বাঁচলেও প্রত্যেকেই অল্প চোট পায় হাতে, পায়ে। নার্ভাস হয়ে পড়ে শুভ্রা। মানব তাকে জল খাইয়ে, চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। গাড়ি থেকে বাইরে বের করে এনে রাস্তার ধারে বসায়।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর মানব এবং শুভ্রা সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ফেরার। শুভ্রা মানবকে জানায়, ‘কাজটা বোধহয় আমরা ঠিক করছিলাম না, তাই এমন দুর্ঘটনা ঘটল। চলো, ফিরে যাই। আমার ছোট্ট মেয়েটার জন্যও মন খারাপ লাগছে।’
শুভ্রার কথা শুনে মানবও যেন চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসার পর বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছো শুভ্রা, আমরা বোধহয় সন্তানের প্রতি অবিচার করতে যাচ্ছিলাম নিজেদের সুখশান্তির জন্য। না, আর মনে হয় নতুন জীবন গড়ার সাহস হবে না। এখনও সময় আছে, চলো বাড়ি ফিরে যাই। হয়তো এখন ফিরলে বড়ো বিপর্যয় ঘটবে না। চলো আমরা আগের মতো শুধু ভালো বন্ধু হয়ে থাকি।
—তাই চলো। সম্মতি জানাল শুভ্রাও। তারপর ওরা কিছুটা হেঁটে গিয়ে, ওদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ির চালকের সাহায্যে একটা গাড়ি ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করল ওই অঞ্চলের এক ‘কার সাপ্লায়ার্স’ সংস্থা থেকে। ওদের গাড়ি যখন বাড়িমুখি, তখন বাড়ির লোকেদের কথা ভেবে মানব এবং শুভ্রা দু’জনেরই খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ হয়তো ওদের জন্য হুলুস্থুলু কাণ্ড ঘটে গেছে! অফিসের কারওর থেকে কোনও খবর না পেয়ে হয়তো থানায় নিখোঁজ ডায়ারি হয়ে গেছে। তারা ইচ্ছে করেই নিজেদের মোবাইল ফোন বাড়িতে রেখে এসেছে। পরিবর্তে মানব নতুন একটা মোবাইল ফোন কিনে, নতুন নম্বর ব্যবহার করছে। অতএব মানবের স্ত্রী সুমিতা কিংবা শুভ্রার স্বামী বিপ্লব, কেউই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। আর এটাই এখন সবচেয়ে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল মানব এবং শুভ্রার কাছে।
ইতিমধ্যে বাড়িমুখি গাড়িটা অনেকটাই পথ পিছনে ফলে এসেছে। হয়তো আর এক ঘন্টার মধ্যে ওরা কলকাতায় পৌঁছেও যাবে। আর যে উদ্দেশ্যে ওরা সংসার ত্যাগ করেছিল, সেই উদ্দেশ্যের কথা যাতে বাড়ির লোকেরা কেউ বুঝতে না পারে এবং পরিস্থিতি যাতে হাতের বাইরে না চলে যায়, তাই এক উপায় বের করে মানব।
সুমিতার মোবাইল ফোনের নম্বরে ফোন করে মানব জানায়, হঠাৎ অফিসের এক সিক্রেট মিটিং-এ কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল ওদেরকে। গাড়ি দুর্ঘটনার কথাটাও জানায়। কিন্তু ওদের যে কিছু হয়নি এবং ওরা যে বাড়ি ফিরছে, তা জানিয়ে আশ্বস্ত করে সুমিতাকে৷ শুভ্রাও মানবের ফোন থেকে কথা বলে বিপ্লবের সঙ্গে। আর কথা বলে জানতে পারে বাড়ির সবাই ওদের খোঁজখবর শুরু করলেও, তখনও থানায় যায়নি। তবে খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিল এবং থানায় যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল বলে জানায় সুমিতা এবং বিপ্লব।
পুরো ব্যাপারটা যে ম্যানেজ হয়ে গেছে এবং পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে যায়নি তখনও, এটা বুঝতে পেরেই আনন্দে মানবকে জড়িয়ে ধরে শুভ্রা। আর মানব ততক্ষণে আবার ফোন করে সুমিতাকে জানায়, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছোবো, চিন্তা কোরো না। আজ ডিনার পার্টি জমিয়ে দেব।’
—ঠিক আছে, তোমরা সাবধানে এসো, আমরা অপেক্ষা করছি। বলেই ফোন কাটল সুমিতা। আর সুমিতার কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত ভাব অনুভব করে মানব শুভ্রার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে জানাল, ‘আর কোনও চিন্তা নেই। দুর্যোগ কেটে গেছে।’