তবে টেগালালও রাইস টেরাসের দোলনার কথা না বললে লেখাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! রাইস টেরাসের মধ্যে সুদীর্ঘ পাম গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়েছে এই দোলনাগুলো। দোলনার উপর থেকে ‘বার্ডস আই ভিউ’-এ সম্পূর্ণ রাইস টেরাসটা দেখা যায়। এত উঁচুতে দোলনায় চড়ার আনন্দ আর তার পাশাপাশি ভয়, সব মিলিয়ে এরকম অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ জীবনে খুব কমই আসে। সারাদিনের শেষে জীবনখাতার স্মৃতির পাতায় বেশ কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে হোটেলে ফিরলাম।

দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেছে। আজ খুব সকালে উঠে বালির পূর্ব উপকূলে আমেদ বিচ দেখতে বেরোলাম। সলিহিন আগেই বলে দিয়েছিল সকালের দিকে ইস্ট কোস্ট ট্রাভেল করতে ভালো লাগবে। আমরা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলাম। রাতের কালো পর্দা ধীরে ধীরে সরিয়ে বালির আকাশে সূর্যের ছটা ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি ফোনে ম্যাপ দেখে সন্নিহিনকে বললাম, “আমাদের সানুর বিচে নিয়ে যেতে পারবে? এখান থেকে খুব কাছেই হবে। আমি আগে ওখানেই যেতে চাই।”

সলিহিন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? আমেদ বিচে যাবেন না?’

তখন বোঝানোর সময় নেই। বললাম, “তুমি আগে গাড়িটা ঘোরাও, তারপর বলছি।’

গাড়ি সানুরের পথ ধরল। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে সলিহিনকে বললাম, “আমেদ পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। চলো সানুর থেকে আজকে বালির সূর্যোদয় দেখে নিই।”

মিনিট দশেকের মধ্যেই সানুর বিচে পৌঁছোলাম। সারা রাত পার্টি, গান-বাজনা, হই-হুল্লোড়ের পর সানুর বিচ যেন ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আশেপাশে কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণকারী ছাড়া তেমন কোনও লোকজন নজরে পড়ল না। সমুদ্রের ধারে বেশ কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে দেখে আর সময় নষ্ট না করে একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম। দেখতে দেখতে পুরো আকাশটা যেন একটা ক্যানভাসে রূপান্তরিত হল।

সূর্যের প্রথম আলো যেন এক লাজুক কবির মতো মঞ্চে এল। আস্তে আস্তে এপ্রিকট থেকে গোলাপি, তার থেকে অরেঞ্জ, সবশেষে সোনালি রং দিয়ে যেন পুরো ক্যানভাসটা রাঙিয়ে দিল। আর সমুদ্র? সে তো নবজাত সূর্যের নীচে এক প্রশান্ত বিস্তৃতি। আকাশের কোমল প্যালেটকে আয়না করে, প্রতিটি তরঙ্গ সামুদ্রিক কবিতায় একটি ক্ষণস্থায়ী স্তবক তৈরি করছে। দেখতে দেখতে সূর্যের রং গাঢ় হল, আশেপাশে পাখির কোলাহল শুরু হল। লোকজনের সংখ্যাও বাড়তে লাগল। বুঝতে পারলাম, এবার সময় হয়েছে যাত্রা শুরুর।

এবার ফ্রি-ওয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। রাস্তায় ট্রাফিক খুব কম। বিচের ধার দিয়ে প্যারালাল ভাবে রাস্তাটা চলেছে। তাই সানুর বিচকে বিদায় জানিয়েও যেন ঠিক বিদায় নয়। সমুদ্র আমাদের সঙ্গে পাশে পাশেই চলছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমেদ বিচ। এটাকে বালির ‘হিডেন জেম’ বলা যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির শিলা আর বালি দিয়ে তৈরি এই উপকূল বালির অন্যান্য বিচগুলোর থেকে বেশ আলাদা। এখানে দুগ্ধস্নাত রেশমি কোমল বালি নেই। রয়েছে আলকাতরার মতো কালো বালি। আর সেই বালির উপর খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমেদ বিচের বালি খুব একটা খুশি মনে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে না। বরং কয়েকটা ছোটো ছোটো পাথরের কুচি পায়ে ঢুকে এ যাত্রার মতো খালি পায়ে হাঁটার শখ মিটিয়ে দিল। কিন্তু রঙে কী আসে যায়? কালো বলে কিন্তু আমেদ বিচের রূপ একটুও কম নয়। বরং বলা ভালো দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের জল আর নীল আকাশের সঙ্গে এই কালো বালি বেশ সখ্যতা করে নিয়েছে। ব্যতিক্রমের মধ্যেও এক বিরল সৌন্দর্য।

আমাদের এর পরের গন্তব্যস্থল ‘তিরতা গঙ্গা’ মন্দির, বালিনিজ ভাষায় যার অর্থ “গঙ্গার জল’। দেশ থেকে এত দূরে বসেও যেন দেশের ছোঁয়া পেলাম। তিরতা গঙ্গা মন্দির কমপ্লেক্স-এর সুপরিকল্পিত ওয়াটার ফিচার, পান্না সবুজ বাগান যে কোনও পর্যটকের মনোরঞ্জন করতে বাধ্য। মন্দিরে ঢোকার মুখে মনে হল এ যেন বালিনিজ সংস্কৃতি, স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক রাজকীয় সংমিশ্রণ। মন্দিরটি ১৯৪৮ সালে কারাঙ্গাসেমের শেষ রাজা তৈরি করেছিলেন। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে ওয়াটার ফিচার। আর এই জলের মধ্যে আছে পাথর খোদাই করে তৈরি করা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি। প্রতিটি মূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বালির ইতিহাস আর লোক-কাহিনির গল্প। এই মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যগুলিতে বালিনিজ, ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ সংস্কৃতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে।

জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলার জন্য অনেকগুলো স্টেপিং স্টোন রয়েছে। দর্শনার্থীরা একের পর এক লাইন দিয়ে তার উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ফটো তোলার জন্য এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়। মন্দিরের চারদিকে নানারকম ট্রপিকাল গাছ। সম্পূর্ণ মন্দির কমপ্লেক্স এত সুন্দর পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়েছে, মনে হচ্ছে সব কিছু একে অপরের পরিপূরক। মন্দিরের নান্দনিক সৌন্দর্য আর ওয়াটার ফিচারে প্রবাহিত জলের মিষ্টি সুর এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। অনেকক্ষণ বাগানে ঝোলানো দোলনায় বসে কাটিয়ে এবার মনে হল ফিরতে হবে। মন না চাইলেও তিরতা গঙ্গাকে এবারের মতো বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে এলাম।

ফেরার পথে সলিহিন আমাদের একটা চকোলেট ফ্যাক্টরিতে নিয়ে গেল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। চারদিকে কোকোর গন্ধ। নানা রঙের, নানা আকারের সব চকোলেট সাজানো। আমি খুব একটা চকোলেটপ্রেমী নই কিন্তু তবুও কীরকম যেন একটা নেশাধরা পরিবেশ। ভিতরে একটা বেশ বড়ো টেস্টিং রুম রয়েছে। কত বাহারি রকমের চকোলেট সাজানো আছে। মনে হল যেন বোতলের ভিতর থেকে চকোলেটগুলো আমায় ডাকছে ওদের একবার হাতে তুলে নেবার জন্য, একবার একটু চেখে দেখবার জন্য। কিন্তু না, আমি অপারগ। ছোটো ছোটো চকোলেটের টুকরোগুলো বিরহিনীর মতো মুখ করে পিছন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তবুও ফেরার পথে বেশ কয়েক প্যাকেট চকোলেট কিনে নিলাম, জানি দেশে ফিরে কাজে লাগবে। চকোলেট ভালোবাসে না এমন লোক খুব কমই আছে।

সলিহিন কাল বলেছিল একটা মন্দিরে নিয়ে যাবে। তাই আর হোটেলে না ফিরে ডেনপাসার ছাড়িয়ে সাউথ বালির দিকে ড্রাইভ করতে শুরু করল। আমি আর ধৈর্য রাখতে না পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি? কোনও মন্দিরে?”

সলিহিন হেসে বলল, “যদি পথে ট্রাফিক বেশি না থাকে আর আপনার ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে দুটো জায়গায় নিয়ে যাব।”

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...