আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছোলাম জিম্বারণ। এখানেই রয়েছে সেই পৃথিবী বিখ্যাত গরুড় বিষ্ণু মূর্তি। শিল্প আর ধর্মের এক অপূর্ব সুরেলা মিশ্রণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১২০ মিটার উঁচু এই মাস্টারপিস, যেটা বিশ্বের সব থেকে লম্বা মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি। আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই মূর্তি। মূর্তির সূক্ষ্ম কারুকার্য প্রথম দেখাতেই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিল। গরুড় তার শক্তিশালী ডানা বিস্তৃত করে ওড়ার জন্য প্রস্তুত। তার উপর বিষ্ণু দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্দোনেশিয়াতে গরুড় জাতীয় প্রতীক। শক্তির প্রতীক।
বিকেলের দিকে এখানেই দেখার সুযোগ পেলাম বালির বিখ্যাত কেচাক ড্যান্স। এর আর এক নাম ‘অগ্নি নৃত্য’। নৃত্যশিল্পীরা খালি পায়ে আগুনের উপর নাচ করে বলেই এরকম নামকরণ। তবে আজকে আমরা দেখলাম বিষ্ণু আর গরুড় ড্যান্স। বালির অন্যান্য শিল্প ও সংস্কৃতির মতো এখানকার নৃত্যশিল্পেও ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ প্রভাব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একই নাচের মধ্যে কী সুন্দর ভাবে গরুড়, বিষ্ণু আর ড্রাগন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এখানেই হয়তো শিল্পের জয়।
এরপর যাচ্ছি সানসেট দেখতে। গাড়ি চালাতে চালাতে সলিহিন বলল, ‘এবার আপনাদের নিয়ে যাব উলুওয়াতু মন্দিরে। এটা বালির খুব জনপ্রিয় সানসেট দেখার জায়গা।’
—কিন্তু উলুওয়াতু মন্দির তো বালির খুব বিখ্যাত মন্দির বলে জানি!
—হ্যাঁ, লোকে মন্দির দেখতে আসে। সেই সঙ্গে সানসেটও দেখে যায়।
মনে মনে ভাবলাম ‘এ যাত্রায় তাহলে রথ দেখা আর কলা বেচা’ – দুটোই একসঙ্গে হয়ে যাবে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোলাম উলুওয়াতু মন্দিরে। ভারত মহাসাগরের উপকূলে, সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৭০ মিটার উপরে খাড়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই মন্দির। বালিনিজ ভাষায় ‘উলু’ অর্থ ‘শীর্ষ’ এবং ‘ওয়াতু’ মানে ‘পাথর’। মন্দিরটি বালিনিজ হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ঈশ্বর সাং হায়াং উইধি ওয়াসাকে উৎসর্গীকৃত। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এটা যে দশম শতকের আগেই কোনও সময় তৈরি হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। উলুওয়াতু মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় তাৎপর্যই বহন করে না। বরং বেশির ভাগ পর্যটক এখানে মন্দির এবং তার আশেপাশের ভারত মহাসাগরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখার জন্য আসে।
গাড়ি পার্ক করে প্রায় কুড়ি মিনিট হেঁটে শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের উপর গিয়ে পৌঁছোলাম। কিন্তু অবাক হলাম ভিড় দেখে। উপরে উঠে জানতে পারলাম উলুওয়াতু মন্দিরে সাধারণ লোকের প্রবেশাধিকার নেই। তাই বুঝতে অসুবিধা হল না যে, এখানে সবাই আমার মতোই সানসেট দেখতে এসেছে। গোধূলি লগ্নে ভারত মহাসাগরের ধারে পাহাড়ের চূড়ায় এই প্রাচীন মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল বাতাসটা যেন ফ্রানজিপনি আর লবণের গন্ধে ভারী হয়ে আসছে। এরই মধ্যে শুরু হল সূর্যাস্তের রঙের খেলা। সূর্য যেন আজ সমুদ্রের সঙ্গে হোলি খেলায় মেতেছে। সময় যেন থমকে গেল। মহাবিশ্ব আজ আলো আর অন্ধকারের এই পবিত্র মিলনের সাক্ষী হয়ে থেমে গেছে। সূর্য শেষবারের মতো মন্দিরের চূড়ায় তার গৌরবের চূড়ান্ত আগুন নিক্ষেপ করে হঠাৎ করেই দিগন্ত রেখার নীচে ডুব দিল।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সলিহিনকে ধন্যবাদ জানালাম আমাদের এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য। ভালো সময় তাড়াতাড়ি কেটে যায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হল।
পরেরদিন খুব সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম আংসেরি হট স্প্রিং-এর উদ্দেশে। বালির সবুজ ল্যান্ডস্কেপের নরম আলিঙ্গনের মধ্যে অবস্থিত এই হট স্প্রিং প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি। একটি অভয়ারণ্য যেখানে সময় নিজেই থেরাপিউটিক জলের অলস ছন্দে ধীর হয়ে গেছে। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যটকদের আনন্দ দানের জন্য তৈরি করা হয়েছে কতগুলো উষ্ণ প্রস্রবণ পুল। পুলের পাশে রয়েছে সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা বাগান। বাগানের পাশেই রয়েছে ট্রপিকাল বুশল্যান্ড। জলের রং হালকা সবুজ, সম্ভবত জলে গ্রিন অ্যালগি থাকার জন্যই জলের রং এরকম হয়েছে। লোকে বলে ‘সর্ব রোগ হরা’ এই উষ্ণ প্রস্রবণ। শরীরের রোগ কমবে কিনা জানি না, তবে প্রায় ঘণ্টাখানেক সাঁতার কেটে যে মনের সব রোগ ভালো হয়ে গেছে, সেটা অনস্বীকার্য।
আংসেরি হট স্প্রিং-এ লাঞ্চ করে আমরা এবার রওনা দিলাম উলানডানু টেম্পল-এর দিকে। বেরাটন হ্রদের ধারে অবস্থিত এই মন্দির। উলানডানু মন্দিরটি সপ্তদশ শতকে মেঙ্গউইয়ের রাজা আই গুস্তি আগুং পুতু, হ্রদ এবং নদীর দেবী দানুকে উৎসর্গ করে তৈরি করেছিলেন। পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাস, স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ আর সেই সঙ্গে ফ্রানজিপনি ফুলের মিষ্টি গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বৌদ্ধ প্যাগোডা স্টাইলে পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে এই মন্দির। এর সুন্দর লোকেশন, নির্মল পরিবেশ এবং বেরাটন হ্রদের শান্ত জলে মন্দিরের প্রতিফলন দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে আসে। মন্দিরের চারদিকে সুন্দর সাজানো বাগান, রেস্তোরাঁ— সব কিছুর ব্যবস্থা রয়েছে।
মন চাইছিল এই শান্ত পরিবেশে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে। কিন্তু সলিহিন তাড়া দিয়ে বলল, ‘আপনার উইশ লিস্টে আরও দুটো জায়গা আছে। এখন না বেরোলে সে দুটো বন্ধ হয়ে যাবে।’ তাই গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
উলানডানু টেম্পল থেকে খুব কাছেই আছে বালির আরেকটি হিডেন জেম, যাকে বালিনিজরা বলে “টুইন লেকস’। বুয়ান এবং তাম্বলিংগান লেক দুটো পাশাপাশি রয়েছে, দেখে মনে হয় যেন শতাব্দী ধরে দুই বোন এখানে বসে আছে কারও অপেক্ষায়। এদের অপেক্ষার কখনও শেষ হবে কিনা আমার জানা নেই, তবে আমার অপেক্ষার শেষ হল খুব তাড়াতাড়ি। আমরা দুটো লেকের ঠিক মাঝখানে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে নেমে এলাম। এখান থেকে দুটো লেককে একসঙ্গে দেখা যায়। এখানে পর্যটকদের দেখার সুবিধার জন্য উঁচু করে স্ট্যান্ড বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব সাবধানে স্ট্যান্ডের উপর উঠলাম।
আজকের দিনটা একটু মেঘলা। তবে মেঘলা আকাশ, কুয়াশা ঢাকা লেক দুটো আর চারদিকের সবুজ ঘন বন— সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত মায়াবী শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে শুধু পাখির ডাক আর গাছের পাতা নড়ার শব্দ ছাড়া যেন আর কিছু নেই। নিস্তব্ধতার যে একটা নিজস্ব শব্দ আছে, আজ এখানে দাঁড়িয়ে সেটা উপলব্ধি করলাম।
আজকে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল হল গিটগিট ওয়াটার ফলস। বুয়ান লেক থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, বালির উত্তরে প্রায় শেষ সীমানায় এই জলপ্রপাত। বালি শুধু মন্দিরের জন্য নয়, জলপ্রপাতের জন্যও প্রসিদ্ধ। বালিতে এসে কোনও জলপ্রপাত দেখব না, সেটা কী করে হয়। তাই গিটগিটকে লিস্টে রেখেছিলাম। এটা বালির মেন ট্যুরিস্ট স্পট থেকে বেশ অনেকটাই দূরে, তাই ভেবেছিলাম এখানে ভিড় একটু কম হবে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি গিটটি শুধু আমার অপেক্ষাতেই বসে থাকবে।
বুয়ান লেক থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। বেশ আঁকাবাঁকা আর এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা। আধঘণ্টার উপর লাগল পৌঁছোতে। খুব খুশি মনে গাড়ি থেকে নেমে ভাবলাম পৌঁছে গেছি। কিন্তু তখনও জানি না, পৌঁছেছি শুধু পাহাড়ের নীচে। গাড়ি এই পর্যন্তই আসতে পারে। এরপর হেঁটে পাহাড়ের উপরে উঠতে হবে। এতদূর এসে ফিরে যাব, গিটগিট ফলস দেখব না! কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে এক বোতল জল হাতে নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের উপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। কোনও কোনও জায়গায় সিঁড়িগুলো খাড়া ভাবে উপরে উঠে গেছে। আবার কোথাও বেশ ফ্ল্যাট। আমরা উপরে ওঠার সময় দেখলাম কয়েকজন ট্যুরিস্ট নেমে আসছে। হাঁটছি আর হাঁটছি। পথ যেন আর ফুরোয় না। এদিকে সূর্যও প্রায় অস্ত যাবার মুখে। পা চালিয়ে হাঁটতে না পারলে সন্ধ্যা হবার আগে গিটগিট পৌঁছোতে পারব না। আরও কিছুটা পথ উপরে উঠে কানে এল গিটটি ফলসের জল পড়ার শব্দ। শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলাম জলপ্রপাতের ঠিক নীচে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। এত কষ্ট করে আসাটা বিফল হয়নি। আশেপাশে কেউ নেই। শুধু আমরা তিনজন। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে, মন ভরে নিয়ে এলাম।
কাল রাতে হোটেলে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে উঠেই কুটা বিচের ধারে মর্নিং ওয়াকে বেরোলাম। কত লোক এরই মধ্যে বিচে চলে এসেছে। কেউ হাঁটছে, কেউ জলে সার্ফিং করছে। সকালের কুটা বিচকে এক সম্পূর্ণ আলাদা রূপে দেখতে পেলাম। এখন কোনও ব্যস্ততা নেই, চিৎকার চেঁচামেচি নেই, ফ্লাড লাইট-এর চোখ ধাঁধানো আলো নেই। প্রকৃতি যেন একটু সুযোগ পেয়েছে জিরিয়ে নেবার। আমরাও হোটেলে ফিরলাম। আমাদের একটু পরেই বেরোতে হবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।