বাড়ির আর সকলের থেকে শিশুকন্যাটির সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে ওঠে তার ‘মা’। প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠার সমস্তটাই কিন্তু তার মা-কে ঘিরে। এইভাবেই সে ধীরে ধীরে মায়ের উপর হয়ে ওঠে নির্ভরশীল। বিশ্বাস করতে শেখে মা-কে। কারণ, তার কাছে মা-ই হচ্ছে একমাত্র ভরসার জায়গা। মায়ের কাছেই শিক্ষার নতুন পাঠে তার প্রবেশ। আর তাই মা আর মেয়ে- যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক।
মেয়ে পা-রাখে শৈশবে। স্কুল জীবনের প্রারম্ভ। মায়ের নিশ্চিত আশ্রয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরের জগতে প্রথম পদক্ষেপ। প্রথম প্রথম আগের থেকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে মা-কে। তারপর মুঠি আলগা হতে শুরু করে। বন্ধুবান্ধব এবং আরও অনেক সম্পর্কের ভিড়ে মা ও মেয়ের সম্পর্ক নেয় নতুন এক মোড়।
মায়ের স্নেহ মিশ্রিত শাসন শুরু হয়। এর সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে মেয়ে জীবনের শিক্ষারও প্রথম পাঠ নিতে শুরু করে। জীবনের পাঠক্রমে শাসন এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিশু যা এতদিন নিজের ইচ্ছেমতোন করে এসেছে, হঠাৎ করে সেখানে বাধা পেতে শুরু করে। ‘এটা কোরো না’, ‘ওটা করে আসা তোমার উচিত হয়নি’, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা না করে এটা করবে না’ কিংবা ‘ওখানে যাবে না’— এরকম মায়ের নানা ‘মানা’-র সম্মুখীন হতে হয় মেয়েটিকে।
একদিকে যেমন নিজস্বতা তৈরি হতে থাকে, তেমনই নানা খুনসুটির মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক শিকড়বাকড় ছড়িয়ে মা ও মেয়ের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। মায়ের সাজগোজের জিনিস কন্যাসন্তানকে শিশু বয়সে সবথেকে বেশি আকর্ষণ করে। মায়ের লিপস্টিক, শাড়ি, গয়না এমনকী মায়ের চটিতে পা গলিয়েই কেটে যায় তার শৈশব। মা বাড়িতে হয়ে ওঠে মেয়ের খেলার সাথী।
অনেক সময় মায়ের প্রতি সামান্য ঈর্ষাও হয়তো মেশে ছোট্ট মেয়েটির মনে। মা কেন এত সাজগোজ করবে, তার কেন এই প্রসাধনের জিনিসগুলো নেই, শুধুমাত্র মা-এর ব্যবহারের জন্যই কেন এগুলি কেনা হয়— এরকম বহু অযথা প্রশ্ন এবং অনুযোগ শিশুমনে উদয় হয়। এর জন্য অনেক সময়ে ছোট্ট মেয়েটি মায়ের প্রতি কিছুটা বিদ্রোহীও হয়ে ওঠে।
এ সমস্ত আচরণগুলি-ই কিন্তু কন্যা সন্তানের বাইরের মনোভাব মাত্র। এর মধ্যে দিয়েই মা ও মেয়ের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, স্নেহ বাড়তে থাকে। মায়ের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যেন সে কৈশোরের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছোয়। কিশোরী মেয়ের খেয়াল রাখা, তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করা যেমন মায়ের অধিকারের মধ্যে পড়ে, তেমনই মেয়েটিও কেমন করে নিজের অজান্তেই মায়ের দিকে আসা প্রতিটি বিপদের সামনে নিজেকে ঢাল হিসাবে তৈরি করতে থাকে। বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে মায়ের প্রতি যে-কোনও ধরনের রূঢ় আচরণ মেয়েটির মনকে নাড়া দেয়। তার ক্ষমতায় অন্যায়ের প্রতিবাদও করে সে।
এরপর কৈশোরের হাত ধরে আসে যৌবন। মা ও মেয়ে উভয়েরই জীবনের কঠিনতম সময়। এই পর্যায়ে মেয়েরা হয় মুক্তপ্রাণ। সবকিছুই তার চোখে তখন সুন্দর, নতুন। সমাজের কুৎসিত রূপটাকেও আস্বাদ করার ব্যাকুলতা তার মধ্যে হয়ে ওঠে প্রবল। মেয়ের প্রতি মায়ের সজাগ দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়। প্রতিমুহূর্তে পদস্খলনের ভয়। মায়ের মন মেয়ের জন্য সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। ফলে শাসনের মাত্রা বাড়তে থাকে। মেয়ের মনে মা-ই হয়ে ওঠে তার জীবনের পরম শত্রু।
এতদিন যে-মেয়ের জীবন ছিল মায়ের কাছে খোলা পাতা, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার বেগ সেটাই এলোমেলো করে দেওয়ার উপক্রম করে। এই সময়ে মা ছাড়া আর সকলকে মনে হয় বন্ধু। জীবনের অনেক নতুন অনুভূতি মেয়েরা এইসময়ে মায়ের কাছে গোপন রাখতে চেষ্টা করে। মায়ের মনেও যে অভিমান জন্মায় না এমন নয়, কিন্তু মায়ের মন বুঝতে পারে তার সেই ছোট্ট মেয়েটি, যে ‘মাতৃকবচ’-এর সুরক্ষার বেড়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে।
শুধুমাত্র মাতৃস্নেহে বেঁধে রাখার সময় সে পেরিয়ে এসেছে। যুবতি মনে অন্য সম্পর্কে পা রাখার আকাঙ্ক্ষা তার মনে তৈরি হয়েছে। অভিমান ঝেড়ে ফেলে মা নেমে পড়ে জীবনযুদ্ধে। মনে তখন মায়ের নতুন উদ্যোগ। এতে মায়ের প্রতি মেয়ের রাগ কমে না, বাড়েই। মায়ের দায়িত্ব থেকে মাকে টলাতে না পেরে, মেয়েরাও মায়ের প্রতি কিছুটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। কোথা থেকে মা পায় এত শক্তি— এই প্রশ্ন ওঠে প্রতিটি যুবতির মনে।
মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মায়ের প্রতীক্ষা শেষ হয়। মায়ের মন শূন্য করে মেয়ে চলে যায় অন্য সংসারে। মায়ের কাছে মেয়ের চলে যাওয়াটা শরীরের একটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ফেলার মতোই বেদনাদায়ক। তবুও মায়ের মনে সান্ত্বনা যে, মেয়ে নিজের সংসারে গেছে, যেখানে তার আদরের মেয়ে সমান আদর-যত্নে স্বামীর সংসারে রাজত্ব করবে। শত কষ্টেও মেয়ের সুখের কথা ভেবে মায়ের মুখে হাসি লেগে থাকে। দূর থেকেই মেয়েকে আশীর্বাদ করে, মেয়ের খোঁজখবর রাখে। বয়সের ভার যেন মায়ের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চায়।
নিজের সংসারে এসে, সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে মেয়ে উপলব্ধি করতে পারে, তার জীবনে মায়ের অবদান কতখানি। মায়ের মতো প্রিয় বান্ধবীর জায়গা কেউ যে নিতে পারবে না, সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না। মায়ের স্নেহ, শাসন সবটাই সন্তানের কাছে কতটা প্রয়োজনীয়, এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মেয়ে বুঝতে পারে। মায়ের সঙ্গে নাড়ির টানটা নতুন করে অনুভব করে। মায়ের সতর্কতা, শাসনের কড়া বুলিই যে তাকে চোরাগলির অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে এসেছে, সেটাতে কৃতজ্ঞ বোধ করে। মন চলে যায় মায়ের কাছে, ফিরে আসে ছোটোবেলার স্মৃতি।
মেয়ের হাত ধরে, জীবনের এতটা পথ পার করিয়ে দিয়েছে মা। ঝড়, জল মেয়েকে স্পর্শ করতে পারেনি। মেয়েকে রাস্তা দেখাবার প্রয়োজন আর নেই। সেই পাঠ তার শেষ হয়েছে। আজ মায়ের পাশে দাঁড়াবার প্রয়োজন মেয়ের। তার এই সফরে মেয়েই একমাত্র বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে। কৈশোরে অজান্তে যে মেয়ে মায়ের ঢাল হয়ে সমাজে দাঁড়াতে চেয়েছিল, আজ সত্যি করেই সে মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। নতুন বন্ধুত্ব, হৃদয়ের বন্ধন নতুন করে আবার স্থাপিত হয়। মায়ের ভালোমন্দের দায়িত্ব, দেখাশোনা করার দায়িত্ব, মেয়ে নিজেই তুলে নেয় নিজের হাতে। জীবনের প্রান্তবেলায় মা ও মেয়ের সম্পর্কের সমীকরণ কিছুটা বদলে যায়। শাসন এবং দায়িত্বের গাম্ভীর্যে মেয়েই হয়ে ওঠে ‘মা’।