কয়েক হাজার দ্বীপপুঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত ভারতের খুব কাছের একটি দেশ ইন্দোনেশিয়া। দুটো দেশের নামের কিছুটা মিল ছাড়াও এদের মধ্যে আরও অনেক মিল রয়েছে। এই দুই দেশের প্রাচীন ঔপনিবেশিক ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, আচার-আচরণ, শিল্প, সংস্কৃতি, অনুষ্ঠান, অতিথিপরায়ণ মানুষজন— সব কিছুতেই যেন বেশ অনেকটাই দেশের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আর সেই টানেই বেরিয়ে পড়া ইন্দোনেশিয়ার পথে।
পরিকল্পনা মতো যাত্রা শুরু হল প্রথমে বালি থেকে। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে রওনা দিলাম ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার উদ্দেশে, ডাচ শাসনকালে যার নাম ছিল বাটাভিয়া। বালির ডেনপাসার এয়ারপোর্ট থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। বুকে একরাশ আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে জাকার্তা পৌঁছোলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে যাবার জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি ট্যাক্সি ডেকে হোটেলে যাব বললেই হোটেলে পৌঁছে যাওয়া যায় না। অন্তত জাকার্তাতে তো নয়ই। ট্যাক্সিতে উঠে প্রথমেই বুঝতে পারলাম ট্যাক্সি ড্রাইভার ইংরেজি বুঝতে বা বলতে পারে না। আর দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি ইন্দোনেশিয়ার ভাষা জানি না! জাকার্তাতে আসার আগে আমরা বেশ কিছুদিন বালিতে কাটিয়েছি। তবে বালিতে ইংরেজি বলতে পারে সেরকম ট্যাক্সি ড্রাইভার আগে থেকেই বুক করা ছিল বলে তেমন কোনও অসুবিধা হয়নি। ভেবেছিলাম জাকার্তা দেশের রাজধানী, এখানে নিয়মিত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্যুরিস্ট আসে, কাজেই সবাই অন্তত কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারবে। কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল যে সব সময় হয় না!
এবার কীভাবে হোটেলে পৌঁছোব যখন সেই চিন্তায় মগ্ন, তখন আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে দিল তার হাতের মোবাইল ফোন, অগতির গতি ‘গুগল ট্রান্সলেটর’। শুরু হল আরও এক সংগ্রাম, এটাকে ‘জাকার্তায় ভাষা সংগ্রাম’ বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না হয়তো। এরপর অনেক কষ্টে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বললাম আমাদের হোটেল মার্কিউর-এ পৌঁছে দিতে। আমি যতটা সহজে বললাম, ড্রাইভারের মুখটা ঠিক ততটাই বিহ্বল মনে হল। গুগল ট্রান্সলেটর আর আমাদের দুজনের যৌথ উদ্যোগে বুঝতে পারলাম, জাকার্তা শহরে বেশ কয়েকটি মার্কিউর হোটেল আছে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ই-মেইল ঘেঁটে হোটেলের ঠিকানা বের করে ড্রাইভারকে দেওয়াতে এ যাত্রায় নিজেদের বুক করা হোটেলেই পৌঁছোলাম।
হোটেলটা বেশ সুন্দর। ম্যানেজার খুব দক্ষতার সঙ্গে চেক ইন করিয়ে আমাদের হাতে রুমের চাবি ধরিয়ে দিলেন। আমি চাবিটা হাতে নেবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগামীকাল আমাদের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’
ভদ্রলোক হয়তো মনে মনে ভাবলেন, এটা আর এমন কী কাজ। তাই একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের হোটেলের গাড়ি আপনি সারাদিনের জন্য বুক করতে পারেন। কোনও সমস্যা নেই।’
আমি যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ড্রাইভার ইংরেজি বলতে পারে তো? সে কি এখানেই আছে? আমি কি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে পারব?’ কাল সকালে কোথায় যাব সেটা আজই ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দেব ভেবেছিলাম।
হঠাৎ করেই ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। ব্যাপারটা কী হল ঠিক বুঝতে না পেরে আমিও চুপ করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বললেন, “সরি ম্যাডাম, আমাদের এখানে ইংরেজি বলতে পারে এমন কোনও ড্রাইভার আপনি পাবেন না। হ্যাঁ, তবে আপনি গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে খুব সহজেই ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।’
ওনার মুখে ‘খুব সহজেই’ কথাটা শুনে হাসব না কাঁদব, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবুও একটা গাড়ি বুক করতে বলে চাবি নিয়ে লিফটের দিকে এগোলাম। পনেরো তলায় আমাদের রুম। সন্ধে হয়ে এসেছে। সূর্যাস্ত দেখব বলে বাইরের ব্যালকনিতে বেরিয়ে আবার নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। এটা জাকার্তা শহর। এখানে সূর্য প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। বায়ু দূষণে জাকার্তা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী। আকাশে এক ফোঁটা নীল রং কোথাও খুঁজে পেলাম না। চারদিকে শুধু ধোঁয়াশা। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনে হল যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময় মনে মনে ভাবলাম, মানুষ অভ্যাসের দাস। দিন কয়েক এখানে থাকলে নিশ্চয়ই এটাও অভ্যাস হয়ে যাবে।
এবারের এই জাকার্তা ভ্রমণ একেবারেই পরিকল্পনা বহির্ভূত ছিল। কোথায় যাব, কী করব, কোনও কিছুই প্ল্যান করে আসিনি। তাই এবার শুরু হল গুগল সার্চ। ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে আমার জ্ঞান যে খুবই সীমিত সেটা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারলাম। গুগল সার্চ করতে গিয়ে প্রথমেই জানতে পারলাম আগামীকাল, মানে ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দিবস। প্রথমেই বলেছি ইন্ডিয়ার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার অনেক মিল আছে। অবাক হলাম যখন ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের শরিক হলাম। ইন্দোনেশিয়া আমাদের থেকে দু’বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে। আর স্বাধীনতা দিবসও আমাদের ঠিক দু’দিন পর।
ইন্দোনেশিয়া বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হয়েছে। ইউরোপীয় শক্তির আগমনের আগে ইন্দোনেশিয়া শ্রীবিজয়া এবং মাজাপাহিতের মতো বিভিন্ন শক্তিশালী রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের আবাসস্থল ছিল। এ সময় চীন ও ভারত-সহ প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, বিশেষত বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগীজরা মশলা বাণিজ্যের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় আসে। আর সেই থেকেই শুরু হয় শোষণের ইতিহাস। তারপর সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজদের তাড়িয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। সেই সময় ইন্দোনেশিয়া মশলা, কফি, চা রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল।
(ক্রমশ…)