স্টেশন থেকে অটো রিকশায় বাড়ি আসার পথেই পিসেমশাই হঠাৎ একসময় প্রশ্ন করেন— তুমিই বুঝি শোভন? তুমি গল্প লেখো?
—হ্যাঁ। শোভন লাজুক হেসে জবাব দেয়।
—বাঃ! খুব ভালো কথা। বাংলার বাইরে থেকে বাংলা চর্চা? খুবই প্রশংসনীয় ব্যাপার। বাংলার গৌরব তোমরা। আমরা মিছে ভয় পাচ্ছি যে, বাংলা ভাষা বিলুপ্তির পথে। যা দেখছি তাতে ভয়ের কোনও কারণ নেই। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে তার স্বকীয়তার গুণে তোমাদের মধ্যে দিয়ে, আমি নিশ্চিত। তোমাদের মতো খুদে সাহিত্যিকদের দেখে মনে ভরসা পাচ্ছি। কথা বলতে বলতে পাঞ্জাবির বাঁ-পকেট থেকে নস্যির ডিবে-সহ রুমাল বের করে তাতে টোকা মেরে পিসেমশাইয়ের দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি লেখাপড়া কী নিয়ে করছ?
—ম্যাথেমেটিক্সে অর্নাস সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়েছি।
—বাঃ চমৎকার! তুমি দেখছি ‘এ্যালিস ইন দ্যা ওয়ান্ডারল্যান্ড’ প্রণেতা দ্বিতীয় লুইস ক্যারল। তিনিও গণিতের অধ্যাপক ছিলেন।
—এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? বিশ্ববন্দিত স্বনামধন্য আইনস্টাইন ছিলেন বেহালা বাদক।
হুম শব্দ নির্গত করে পিসেমশাই তাঁর দুই নাসিকা গহ্বরে নস্যি ঠুসে গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করেন— এ যাবৎ আনুমানিক ক’খানা গল্প লিখেছ?
—বেশি নয়, গোটা পনেরো। এর মধ্যে পাঁচটি আমার স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প। শোভন জবাবদিহি করে।
—নিজের গল্প সম্বন্ধে তুমি তো বেশ সচেতন দেখছি। পিসেমশাই মন্তব্য করেন।
—হ্যাঁ, ওই লেখাগুলো আমার বহু বিনিদ্র রজনীযাপনের ফসল।
—কবে থেকে লিখছ?
শোভন উত্তরে জানায় — ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকে লিখতে আরম্ভ করেছি।
পিসেমশাই জানতে চান— এ যাবৎ কোথাও কোনও পত্রিকায় ছেপে বেরিয়েছে?
—না, সেরকম সুযোগ আজ অবধি পাইনি। ক্লাস টেনে পড়ার সময় স্কুল ম্যাগাজিনে একবার ছেপে বেরিয়েছিল আর ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ছাপানো গল্প। তারপর বহু বছর পরে আমার কলেজ আয়োজিত ‘ইন্টার কলেজ অন দ্যা স্পট গল্প প্রতিযোগিতায়” আমি প্রথম হয়েছিলাম।
পিসেমশাইকে নির্বাক বসে থাকতে দেখে অম্লান হঠাৎ বলে ওঠে— আপনার পঞ্চম-এ ওর লেখা একটি গল্প ছাপানো যায় না?
অম্লানের কথার জবাবে পিসেমশাই শোভনের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন— এখনই প্রকাশ করার কথা ভেবে লাভ নেই। উৎকৃষ্ট লেখা কখনও কোনওকালেই অপ্রকাশিত থাকেনি, ইতিহাস সাক্ষী। পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও লেখকের ভালো লেখা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে তা শোনা যায়নি। সুতরাং তুমি শুধু লিখে যাও। ভালো লিখলে একদিন তা নিজগুণে ছেপে বেরোবে। সেই বিষয়ে চিন্তা কোরো না। এও এক প্রকার সাধনা, সেই কারণে বলা হয় সাহিত্য সাধনা। সাধনায় সিদ্ধিলাভ এত সহজে হয় না। চরৈবেতি, চরৈবেতি, নিজের লক্ষে এগিয়ে যাও। মনে রাখবে জীবনে সফলতা পাওয়ার নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়ের জন্যে উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকতে হয়।
রাস্তার দুই পাশের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে পিসেমশাই বলেন— আজ বিকেলে আমার বিশেষ কোনও কাজ নেই। তোমার স্বনির্বাচিত গল্পগুলো নিয়ে এসো। পড়ে দেখব তোমার লেখার হাত কেমন? আমার হাতে কিন্তু সময় বড়োই কম। শুক্রবারে ট্রেন ধরব।
পিসেমশাইয়ের কঠোর নির্দেশ অনুযায়ী বিকেলের দিকে শোভন স্খলিত চরণে, সংকোচিত হৃদয়ে অম্লানের বাড়িতে আসে স্বরচিত গল্পপাঠের উদ্দেশ্যে। পিসেমশাই ছাদে উঠে মুগ্ধ নয়নে চারিদিকের দৃশ্য দেখছিলেন একমনে। অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু তখনও আকাশে লেগেছিল। ছাদটা সূর্যের তাপে গরম হয়েছিল। অম্লান পাইপ দিয়ে জল ছিটিয়ে ছাদটা ঠান্ডা করছিল। শোভনকে দেখতে পেয়ে পিসেমশাই কৌতূহলোদ্দীপক স্বরে প্রশ্ন করে জানতে চায়— গল্পগুলো এনেছ তো?
—হ্যাঁ। শোভনের সংক্ষিপ্ত জবাব।
—বেশ। তারপর অম্লানের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু পরে একটা শতরঞ্চি এনে পেতে দিও। আমেজ করে খোলা আকাশের নীচে বসে একটু সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করা যাক। ছাদে লাইটের ব্যবস্থা আছে তো? দিল্লি শহর তোমাদের বিচারে কেমন লাগে জানি না তবে আমার কিন্তু বড়ো ভালো লাগে। দিল্লির খুব শান্ত পরিবেশ। লেখাপড়া করার জন্যে আদর্শ জায়গা। এত খোলামেলা আর শান্ত পরিবেশ অন্য কোথাও নেই।
ভেজা ছাদটা শুকিয়ে যাওয়ার পরে শতরঞ্চির উপর বসে পিসেমশাই শোভনের হাত থেকে গল্পের খাতাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন— তুমি গল্পের উপকরণ কোথা থেকে সংগ্রহ করো?
শোভন উত্তরে জানায়— আমার লেখা বেশিরভাগ গল্পই কোনও কবিতার লাইন বা কোনও গানের কলি বা খবরের কাগজে প্রকাশিত কোনও ঘটনা বা কোনও মনীষীর বাণী থেকে রচিত। যেমন ধরুন, আমার লেখা ‘স্থানীয় সংবাদ’ গল্পটি। এই গল্পটি আমি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘একটি মোরগের কাহিনি’ কবিতার একটি লাইন ‘খাবার নয় খাবার হিসেবে’-র উপর ভিত্তি করে লিখেছিলাম। আমার লেখা ‘আঁধারে আলো” গল্পটি খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি খবরের উপর ভিত্তি করে লেখা। ঠিক তেমনি ‘বনস্থলী বিদ্যাপীঠ’ গল্পটি আমি রচনা করেছিলাম রামকৃষ্ণদেবের মুখনিঃসৃত চাল-কলা বাঁধা বিদ্যে কথাটির উপর ভিত্তি করে। এইরকম আর কী।
অর্থাৎ আমার দেখা-শোনা কোনও ঘটনার আড়ালে আর কোনও ঘটনা লুকিয়ে আছে কিনা তা আমাকে অস্থির করে তোলে। আসল কথা, সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়। লেখকের নিজস্ব অনুভূতি, কল্পনাশক্তি ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির একটা বড়ো ভূমিকা থাকে। এইসব কিছুই গড়ে তোলে কাহিনির পটভূমি।
—ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই কি লিখতে বসে যাও?
(ক্রমশ…)