কেয়াদিদের বিপদে-আপদে দেবাঞ্জনরাই ছুটে আসে সবচেয়ে আগে। দেবাঞ্জন কেয়াদির চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের ছোটো বলে অবাধ মেলামেশায় কোনও বাধা ছিল না। কেউ ভাবতেই পারত না তখন কেয়াদি আর দেবাঞ্জন প্রেমিক-প্রেমিকা। রাস্তা দিয়ে গেলে লোকে অনুমান করত ওরা ভাই-বোন। ওরা দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসে, একথা অতিবড়ো শত্রুও তখন বলতে পারত না।
সে রাতে হালখাতার পর্ব চুকিয়ে এসে পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পড়ায় ব্যস্ত কেয়াদির চোখ টিপে ধরেছিল দেবাঞ্জন আচমকা। ফিলোসফির বইয়ের পাতায় চোখ থাকলেও কেয়াদির মন দেবাঞ্জনের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তাই দেবাঞ্জন গুটিগুটি পায়ে ঘরে এসে পিছন দিক থেকে কেয়াদির চোখ টিপে ধরামাত্র কেয়াদি পিয়ানোর সুরে বেজে উঠল, ‘তোমার এতক্ষণে আসার সময় হল? তুমি কি জানো না তোমাকে একটা দিন দেখতে না পেলে আমার…’
—কী করব বলো। দোকানে আজ হালখাতা ছিল যে। বছরের এই একটা দিন না গেলে বাবা খুব রাগ করেন। দেবাঞ্জন তার চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল।
সে কথা শুনে কেয়াদি বলল, ‘তা ঢং দেখাতে এলে কেন?’
দেবাঞ্জন হাত থেকে রজনীগন্ধার মালা খুলে কেয়াদির খোঁপায় পরিয়ে দিয়ে বলল, “এলাম এই জন্য। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখো তোমায় কত ‘সুন্দর’ দেখাচ্ছে।’
ব্যস, দেবাঞ্জনের ওই একটা কথায় কেয়াদির সমস্ত রাগ একেবারে গলে জল হয়ে গেল। এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় দেয়ালের গায়ে ফুটে ওঠা সিল্কের পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা দেবাঞ্জনের ছায়ামূর্তিটা দেখে কেয়াদি পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। তারপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেবাঞ্জনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চাপাস্বরে বলল, ‘তোমাকে আর বাচ্চা ছেলে বলে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি অনেক বড়ো হয়ে গেছ। এবার থেকে তুমি আর হাফ প্যান্ট পরবে না। পাজামা-পাঞ্জাবি পরবে, কেমন?’
—আচ্ছা। বলে দেবাঞ্জন কেয়াদিকে ড্রেসিং টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে আবার বলল, খোঁপায় রজনীগন্ধার ফুলের মালা দিলে তোমায় কেমন সুন্দর লাগে দেখো।
কেয়াদি ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হল। খোঁপায় ফুলের মালা জড়ালে যে তাকে দেখতে আরও ভালো লাগে, তা তার জানা ছিল না। কস্তুরী মৃগ যেমন আপন গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে বনের মধ্যে ছুটে বেড়ায়, ঠিক সেইরকম কেয়াদি নিজের রূপের আলোয় আলোকিত হয়ে খুশিতে ফিক্ করে হেসে উঠল। জানলা দিয়ে উড়ে এসে কখন একটা জোনাকি পোকা তার নাকের পাটায় এসে বসেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ জোনাকিটা জ্বলে উঠতেই দেবাঞ্জনের মনে হল, কেয়াদি আজ লাল পাথর বসানো নাকছাবি পরেছে।
গত বছর গরমের ছুটিতে বাবার সঙ্গে খাজুরাহোর মন্দিরে পাথরে খোদাই করা ঠিক এরকম একটি মূর্তি সে দেখেছিল। কিন্তু এক বছর আগে দেখা পাথরের সেই অপূর্ব সুন্দরী নারীর সঙ্গে কেয়াদির চেহারার এমন আশ্চর্য মিল হল কী করে। তা হলে কি ভগবান পাথরে খোদাই করা খাজুরাহোর মন্দিরের সেই অপরূপ রূপসীকে জীবন্ত করে আজ দেবাঞ্জনের সামনে এনে দিয়েছে! এ-ও কি সম্ভব?
সম্ভব-অসম্ভবের মধ্যে দেবাঞ্জন যখন দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে, ঠিক তখন কেয়াদি আরও কাছে সরে এসে বলল, ‘কী দেখছ অমন করে?’
—লাল পাথর সেট করা নাকছাবিটায় তোমায় খুব সুন্দর মানিয়েছে। দেবাঞ্জন বলে উঠল।
কেয়াদি নাকে হাত দিয়ে বলল, “কই নাকছাবি তো পরিনি।”
কেয়াদির হাতের ছোঁয়ায় জোনাকি পোকাটা জানলার বাইরে উড়ে যেতেই দেবাঞ্জন বলল, “ইস, দিলে তো জোনাকি পোকাটাকে উড়িয়ে। তোমার নাকে বসে ওটা যখন জ্বলছিল তখন আমি ভাবলাম বুঝি তুমি আজ লাল পাথর বসানো নাকছাবি পরেছ। সত্যি নাকছাবি পরলে কিন্তু তোমাকে খুব ভালো লাগবে।’
সে কথা শুনে কেয়াদি হাসতে হাসতে দেবাঞ্জনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘তুমি যখন বলছ তখন এ মাসেই একটা নাকছাবি বানাব। জানো, আমার মাঝে মাঝে ভীষণ ভয় করে।’
—কেন? দেবাঞ্জন প্রশ্ন করল।
কেয়াদিকে বলতে শোনা গেল, ‘যদি আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়?
দেবাঞ্জন বলল, “দূর, তা কখনও হয় নাকি? তা ছাড়া তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির কথা ভাবতেই পারি না।”
সে কথা শুনে কেয়াদি ফিসফিস করে বলল, ‘সৃষ্টিকর্তা কেন যে আমার চাইতে তোমাকে বয়সে ছোটো করলেন বুঝি না। তাঁর কী এমন ক্ষতি হতো তোমাকে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়ো করলে? লোকে যখন জানবে আমি একটা পুঁচকে ছেলের সঙ্গে প্রেম করছি, তখন তারা আমার নামে নিন্দে করবে!”
তার উত্তরে দেবাঞ্জন বলল, ‘আমি লোকের কথাকে কেয়ার করি না। বড়ো হয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াব, তখন আমি তোমাকেই বিয়ে করব। কে কী বলল আমার কিছু যায় আসে না।”
আধো আলো আধো অন্ধকারে কেয়াদির কান্নাভেজা স্বর শোনা গেল, “ঠাকুর যেন তাই করেন!”
দেবাঞ্জন কেয়াদির মুখটা দু’হাতে তুলে বলল, “তুমি কিছু ভেবো না তো। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখন তুমি এই চেয়ারে চুপটি করে বোসো। তোমাকে আজ আমি নিজের হাতে সাজাব। আমার মনের মতো করে।”
কেয়াদিকে কেন্দ্র করে দেবাঞ্জন যত ছেলেমানুষি করত, কেয়াদির প্রেম তত গভীর হতো। সে সময় দেবাঞ্জনের আন্তরিক ব্যবহার, চালচলন কেয়াদিকে এমনই আকৃষ্ট করেছিল যে, সে অন্য কোনও পুরুষকে কল্পনাই করত না। অথচ অনেক বড়োলোকের ছেলে কেয়াদির পিছনে লাইন দিয়েছিল প্রেম করার জন্য। কেয়াদি তাদের কাউকে পাত্তা দেয়নি। তার ধ্যানজ্ঞান শুধু দেবাঞ্জন। দেবাঞ্জনকে একদিন দেখতে না পেলে সে কেঁদে ভাসিয়ে দিত। আসলে দেবাঞ্জনের সহজ সরল রোমান্টিক কথাবার্তা ও অত্যন্ত ছেলেমানুষি ভাবটাই কেয়াদিকে পাগল করে তুলেছিল।
তা না হলে সে দিন মধ্যরাতে দেবাঞ্জন হঠাৎ কেয়াদিকে সাজাবে বলে যে বায়না ধরল সেটা কি ওর কম ছেলেমানুষি? আর আশ্চর্য, কেয়াদিও ওর হাতে সাজবে বলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুপচাপ বসে পড়ল ছোটো মেয়েটির মতো। কেয়াদির মতো সুন্দরী নারীকে একান্ত করে কাছে পেতে গেলে প্রেমের যে-জাদুবিদ্যা জানা দরকার, তা দেবাঞ্জনের ছিল। ছিল বলেই দেবাঞ্জন তখন পাউডারকে জলে গুলে দেশলাই কাঠি দিয়ে কেয়াদির কপালে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা দিয়ে চন্দনের আকারে সাজিয়ে দিল।
শুধু কি তাই। সে যখন আলতার শিশি নিয়ে কেয়াদির পা রাঙাতে বসল, তখন কেয়াদি না বলে পারল না, ‘এ কী করছ। তুমি আমার পায়ে হাত দিলে যে আমার পাপ হবে।’
সে কথা শুনে দেবাঞ্জন বলল, “কিছু হবে না। তুমি জানো, রাধার পায়ে শ্রীকৃষ্ণ কতবার আলতা পরিয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণ যদি পারে, তা হলে আমি পারব না কেন?”
—কৃষ্ণ অবতার পুরুষ। ওঁর কোনও দোষ নেই। কিন্তু আমি মানুষ। আমি বলছি তুমি আমার পায়ে হাত দিলে আমার পাপ হবে। লক্ষ্মীটি আমার কথা শোনো। কেয়াদি দেবাঞ্জনের হাতটা ধরে মিনতি করল।
কিন্তু যে প্রেমকে স্বর্গীয় রূপ দিতে চায়, সে কি কখনও কারও কথা শোনে। তাই বুঝি সে কেয়াদির ফুলের মতো নরম পা দু’খানি হাতে তুলে নিয়ে সযত্নে আলতা পরাতে বসল। এমন যার শিশুসুলভ মন তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায়। দেবাঞ্জনের এই হঠাৎ পাগলামোটাই তো কেয়াদির কাছে পরম রতন।
আলতা পরানো হলে দেবাঞ্জন কেয়াদির একটি রাঙানো পায়ের ঘ্রাণ নিয়ে বলল, ‘আহা পা তো নয়। যেন সরোবরে ফোটা পদ্মফুল।’
দেবাঞ্জনের কথা শুনে কেয়াদি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ফর্সা মেয়ে যদি লজ্জায় লাল হয়, তাহলে তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। কপালে চন্দনের আকারে রচিত গলন্ত বিন্দু বিন্দু ফোঁটা আর খোঁপায় রজনীগন্ধা ফুলের মালা জড়ানো এবং পায়ে আলতা পরার জন্য কেয়াদিকে ঠিক বিয়ের কনের মতো মনে হচ্ছিল। বাইরের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে কেয়াদির মনে হল যেন সানাই বাজছে।
একটু পর আবেগের বশে সে পাশের ঘরে গিয়ে লক্ষ্মীর পট থেকে গলন্ত সিঁদুর আঙুলে করে নিয়ে এসে বলল, “আজ পয়লা বৈশাখ শুভদিন। আজ তুমি আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দাও। কেউ না জানুক ঠাকুর জানেন তুমিই হলে আমার স্বামী।’
দেবাঞ্জন যেন তখন আর কিশোরটা নেই। তার মনে হল, সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে পরিপূর্ণ যুবকের মতো কেয়াদির সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল। কেয়াদি উঠে দাঁড়াতেই দেবাঞ্জনের অশান্ত ঠোঁট দুটো লুটিয়ে পড়ল কেয়াদির রাঙা ঠোঁটে। কেয়াদি তাকে বাধা না দিয়ে এমার্জেন্সি লাইটের আলোটা কমিয়ে দিল। আস্তে আস্তে দেবাঞ্জনের উন্মত্ত ঠোঁট নেমে এল কেয়াদির উন্নত অনম্র স্তনচূড়ায়, তারপর মাখনের মতো নরম নাভিকুণ্ডে। তারও পর পয়লা বৈশাখের রাতে দুটি অসম বয়সের প্রেমিক-প্রেমিকার দেহ-মন এক হল।