সঠিক উপলব্ধি এবং মূল্যবোধ-ই সন্তানকে জীবনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়। অথচ, আমাদের সমাজে মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। তবে, প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সন্তানকে সব দিক দিয়ে সফল করতে মা- বাবা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেন না। একদিকে উপলব্ধি কিংবা বোঝার চেষ্টা আর অন্যদিকে জীবনের সঠিক মূল্যবোধগুলির সঠিক নির্মাণ করতে করতেই বাচ্চাদের জীবন চলতে থাকে। আসলে, মূল্যবোধের লিস্ট বিশাল লম্বা কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা কাকে গুরুত্ব দিতে হবে এটা নিয়ে বাচ্চারা কনফিউজড হয়ে পড়ে। কিছু কিছু মূল্যবোধ যেমন শালীনতা, নম্রতা, ত্যাগ, সহানুভূতি, দায়িত্ব,কর্তব্যপরায়ণতা, সততা ইত্যাদির সঠিক অর্থ অনেক মা-বাবাও জানেন না হয়তো।
সাইকোলজিস্টদের মতে, তোতা পাখিকে বুলি শেখানোর মতো বাচ্চাদের জীবনের মূল্যবোধ শেখানো যায় না। যদি মা-বাবা নিজেরা সৎ এবং ধৈর্য রেখে বাচ্চাদের ভালো কিছু শেখান, তবেই তারা জীবনে সফল হবে। আর তা যদি না হয়, অর্থাৎ মুখস্থবিদ্যার মতো করে যদি বাচ্চারা মূল্যবোধের শিক্ষা নেয়, তাহলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চাটিকে পড়তে হতে পারে, যেখানে তার শিখে আসা মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ইভা বাড়িতে মা-বাবার কাছে সবসময় বড়োদের সম্মান করার কথা শুনেছে এবং সেই মতো চলারও চেষ্টা করে। স্কুলে শিক্ষিকাদেরও যথেষ্ট সম্মান করে কিন্তু সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওদের ইতিহাসের শিক্ষিকা ইভা-র উপর ক্ষুব্ধ হন। ইভা ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পরেও, পরীক্ষার খাতায় ইভা-র প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খাতা নিয়ে সরাসরি ইভা ওই শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলে এবং শিক্ষিকা মানতে না চাইলেও, মা-বাবার বারণ অগ্রাহ্য করে ইভা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে নালিশ জানায়। এখানে ইভা-র মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শিক্ষিকাকে অসম্মান করা ছিল না। তার বিদ্রোহ ছিল নিজের উপর হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে।
প্রভাব পড়ে ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপরেও
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা একতাল ভিজে মাটির মতো। যেমন শেপ দিতে চাইবেন, সেই ছাঁচে ঢেলে নিতে হবে। এই দায়িত্বটা কিন্তু মা-বাবার। তাদের সন্তানকে কীভাবে তারা গড়ে তুলবেন, তা তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। জীবনের মূল্যবোধগুলো বাচ্চারা শেখে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। এখনকার জেনারেশন নতুন টেকনিক্যাল গ্যাজেটস-এর উপর নির্ভরশীল। ছোটো বয়সেই শিশুদের হাতে মা-বাবারা স্মার্টফোন, আইপ্যাড, আইফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি তুলে দিচ্ছেন এই ভেবে যে, তাদের বাচ্চা স্মার্ট কিড তৈরি হবে। অথচ মা-বাবা সন্তানকে যা যা শেখাবার বা বলার চেষ্টা করেন, তার পঞ্চাশ শতাংশই বাচ্চারা কানে তোলে না। এইভাবেই স্কুল থেকে কলেজে এবং কলেজ থেকে চাকরির জায়গাতেও এই বাচ্চারাই অন্যের কথা শুনতে চায় না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বড়ো হয়েও। এই ধরনের মানসিকতা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপরেও প্রভাব ফেলে।
এখন অভিভাবককেরা বেশিরভাগই ওয়ার্কিং। সুতরাং স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং-ও আগের তুলনায় অনেক উঁচু। বাচ্চা কিছু চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার কাছ থেকে সেটা সে পেয়ে যায়। চাইল্ড সাইকোলজিস্টদের মতে, স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং না বাড়িয়ে বরং অভিভাবরকদের উচিত স্ট্যান্ডার্ড অফ গিভিং বাড়ানো। অবসর পেলেই বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত, ওদের প্রয়োজনে সবসময় ওরা যেন মা-বাবাকে পাশে পায়। অন্যের মুখ থেকে না শুনে নিজের বাচ্চার থেকে শুনে তবেই কোনও মতামত দেওয়া উচিত বড়োদের।
আজকাল কোনও অনুষ্ঠান অথবা পার্টিতে বাচ্চারা জমায়েত হলে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে মা-বাবার সঙ্গে আনন্দ শেয়ার না করে, নিজেদের মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভালো গল্প বলার ক্ষমতাও নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেকই কম। বাচ্চাদের কথার মধ্যে অ্যাগ্রেসিভ ভাব এখন অনেক বেশি। এই প্রজন্মের অ্যাগ্রেসিভনেস টোন করা খুব জরুরি। বাচ্চাকে কোনও কিছু করতে বারণ করা হলে তার কারণটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলাও খুব প্রয়োজন। বাচ্চাকে শিষ্টাচার শেখাতে চাইলে মা-বাবারও জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।
আত্মবিশ্বাসও প্রভাবিত হয়
এখন বেশিরভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যেখানে বাচ্চারা শুধুমাত্র মা-বাবার সঙ্গেই মেলামেশা করার সুযোগ পায়। এক্সটেনডেড ফ্যামিলি বলতে আর কিছু থাকে না। দাদু, ঠাকুমা, অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বছরে হয়তো দেখাই হয় শুধু কয়েকবারের জন্য। জীবনের মূল্যবোধ শেখা শুরু হয় ডাইনিং টেবিলে বসে। কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়াটা ‘টিমওয়ার্ক’ হয়ে ওঠে। এইসবের প্রভাব পড়ে বাচ্চার আত্মবিশ্বাস গঠনের উপরেও।
অভিভাবকেরা এর জন্য কতটা দায়ী
অভিভাবকরা বাড়িতে থেকেও, ‘বাবা-মা বাড়িতে নেই’ বলে বাচ্চাকে দিয়ে বাইরের লোকেদের বার্তা পাঠান। এই ধরনের ব্যবহার বাচ্চাদের আরও কনফিউজ করে দেয়।
মনোবৈজ্ঞানিক এবং পেরেন্টিং এক্সপার্টদের মতে, শিশু ছোটো থেকেই পরিবারের মধ্যে থেকে মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে শেখে। তাই মা-বাবার উচিত নিম্নোক্ত কিছু জিনিস খেয়াল রাখা।
- বাচ্চাকে সারাদিনে কম করে এক ঘণ্টা সময় দিন, যে-সময়টাতে আপনি শুধু বাচ্চার কথাই শুনবেন
- বাচ্চাকে যেটা বলবেন করতে, সেটা নিজেও পালন করার চেষ্টা করবেন
- বাচ্চার মধ্যে সহানুভূতির উদ্রেক করার চেষ্টা করুন। মুখে বলার থেকে কাজের মধ্যে দিয়ে শিশুর মনের গভীরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করুন
- নিজের মূল্যবোধগুলি সম্পর্কে বাচ্চাকে বলুন এবং সেগুলো কেন জরুরি সেটাও ওকে বুঝিয়ে দিন
- জীবনে মূল্যবোধ থাকাটা কেন দরকার সেটা বিশ্লেষণ করাটা খুব প্রয়োজন
- বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন, উপদেশ নয়। ভালো কিছু করলে তাকে বাহবা দিন
- খাতা কলমে জীবনের মূল্যবোধকে আটকে রাখবেন না, বাচ্চা সেটা মানছে কিনা খেয়াল রাখুন। বাচ্চা সেটা না মানলে, কারণ অনুসন্ধান করুন। সমাধানের রাস্তা খুঁজুন এবং বাচ্চাকে বলুন
- জীবনের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে টাকার গুরুত্বও তাকে বোঝান।