পরের গন্তব্য লক্ষ্মীজলা, যেখানে সারা বছর ধানচাষ হয়। আর সেই সুগন্ধি ধানের চাল দিয়ে জগন্নাথদেবের প্রতিদিনের ভোগ রান্না হয়। এরপর জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি। বিশাল এলাকা। জগন্নাথদেবের রথ এখানে আসে। সেই সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে পুরীতে।
মাসির বাড়ি ঢুকতেই দেখলাম একটা গাছে প্রচুর সুতো জড়ানো। ঢোকার সময় ওই বৃক্ষকে স্পর্শ করে, একজন ধর্মের ধ্বজাধারি বসে আছেন, তাঁকে প্রণামি দিয়ে ভিতরে যেতে হবে। আমি বৃক্ষকে স্পর্শ না করে এবং কোনও প্রণামি না দিয়ে ভিতরে ঢোকার জন্য উনি খুব রেগে গেলেন। আমাকে মহাপাপী, নরকেও ঠাঁই হবে না, বলে গালাগালি দিলেন। আমি মহানন্দে এগিয়ে গেলাম! উনি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে যত পাপ করছেন, আমি সারাজীবনে সে পাপ করতে পারব না— এ ব্যাপারে একশো ভাগ নিশ্চিত।
সব জায়গাতেই বড়ো বড়ো হাঁ করে বসে আছে। তাদের হাঁ-মুখে টাকা ফেললেই মহাপুণ্য। এরই নাম তীর্থ ধর্ম। আমি তো তীর্থ করতে, ধর্ম করতে আসিনি। এসেছি কত না-দেখা স্বপ্ন, পথের পরতে পরতে, নিজেদের সাজিয়ে গুছিয়ে বসে আছে— আমি সেসব বিস্ময়ের রূপ-রস-গন্ধ সব সবকিছু আকণ্ঠ পান করতে চাই। সুতরাং আমার ওই দায় নেই, ওদের হাঁ-গর্তে আমার পকেট হালকা করার কোনওরকম বাজে ইচ্ছে নেই। যত্রতত্র ব্যারিকেড করে, যতরকম ভাবে টাকা আদায় করা যায় তার চেষ্টা!
এরপর সোনার গৌরাঙ্গ। কীর্তন চলছে। প্রণামি বাক্স আছে কিন্তু কোনও জোরজবরদস্তি নেই। ভালো লাগল। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ, নানান মূর্তি সুন্দর ভাবে সাজানো দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। শুনলাম একটা মিউজিয়াম আছে। কিন্তু তার দরজা বন্ধ। সুতরাং বাইরে থেকেই যেটুকু দেখার। এবারে হোটেলে ফেরা। সি-বিচে একটু ঘোরাঘুরি করে, খাজা কিনে সন্ধেকালীন জলযোগ সারা হল।
আজ বহু প্রতীক্ষিত, বহু চর্চিত শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দিরদর্শন। প্রায় সকলেই সকাল থেকে না খেয়ে আছে। উপোস করে পুজো দিলে পুণ্য নাকি অনেক বেশি! বলাবাহুল্য আমি ওই দলে নেই, কোনওদিনই ছিলাম না। যথারীতি পেটপুরে ব্রেকফাস্ট করে রওনা দিলাম। মোবাইল সঙ্গে নিলাম না। শুনলাম, জুতো, মোবাইল, চামড়ার বেল্ট সব বাইরে জমা রেখে মন্দিরের ভিতরে যেতে হবে। হাত, পা, মুখ ধুয়ে নিজেকে পবিত্র করে মূল ফটকে যাওয়া। সেখানে সশস্ত্র প্রহরা। প্রয়োজনে পরীক্ষা করে ঢুকতে দিচ্ছে। আমাদের পান্ডাঠাকুর এক জায়গাতে সবাইকে দাঁড় করিয়ে অনর্গল বকে গেল। বলাবাহুল্য সবটাই ঠাকুরের মহিমাকীর্তন। ভেবেছিলাম খুব সহজেই জগন্নাথ দর্শন হয়ে যাবে !
মাথার উপর গনগনে রোদ। মূল গর্ভগৃহে ঢোকার আগে লাইনে দাঁড়ালাম। সামনে অগণিত পুণ্যলোভী মানুষের আকাঙ্খা, ধীরে ধীরে পিছনেও বিশাল লাইন পড়ে গেল। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর পর, হুড়মুড় করে সামনের মানুষজন কিছুটা এগিয়ে গেল, পিছনের ধাক্কা আমাদেরও এগিয়ে নিয়ে গেল। আবার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা, যাকে বলে ন যযৌ ন তস্থৌ। এরমধ্যেই একটা লোক স্প্রে করে মাঝে মাঝে ঠান্ডা জল ছেটাচ্ছে, তাতে একটু আরাম হচ্ছে। এরকম দু-তিনটে ঢল এল আর গেল। এখন কিন্তু আমাদের দলের কাউকে সামনে, পিছনে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কে যে কোথায় ছিটকে গেছে কে জানে? আমাদের সঙ্গে তিনটে বাচ্চা। যদি হারিয়ে যায়!
আমার সামনে ছিল লহরি আর চনমন, তাদেরও দেখতে পাচ্ছি না। কুহু এতটুকু মেয়ে, এই ভিড় কী করে সহ্য করছে? এ তো মরে যাওয়ার মতো অবস্থা! মাথায় থাক জগন্নাথ দর্শন, আমি ভাবছি কীভাবে, কখন এই অবস্থা থেকে বেরোতে পারব? আবার এরমধ্যে এক একটা ব্যারিকেড পার হওয়ার সময় পয়সার দাবি নিয়ে, বসে অথবা দাঁড়িয়ে থাকা যমদূত। প্রত্যেকের মাথায় একটা লাঠির ঘা মারছে আর হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে— দাও, দাও দাও…।
মন্দিরের ভিতরে অন্ধকার, ভালো করে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সিংহাসনে জগন্নাথদেব, বলরাম আর সুভদ্রার মূর্তি। আবছা আলোতে যেটুকু দেখা যায়। এই অবস্থায় দমবন্ধ হয়ে যে-কারওর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। কোনওরকমে গর্ভগৃহের বাইরে এসে বাঁচলাম। মুক্ত হাওয়ায় যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম। ভাবছি, আবার পুরী আসব কিন্তু সেইসময়ে আর জগন্নাথ মন্দিরে আসব না। আসলে ধীরেসুস্থে ঠাকুর দেখার সময় এবং পদ্ধতি আছে। আমাদের মূর্খ পান্ডা সেটা না জেনে, কিংবা জেনেশুনে এই ভিড়ের সময়ে নিয়ে এসেছে। পরে জানা গেল, সন্ধের দিকে টিকিট কেটে ধীরেসুস্থে জগন্নাথদেব দর্শন করা যায় এবং যথারীতি পরেরদিন সন্ধের সময় জগন্নাথ মন্দিরে আবার আমাদের পদার্পণ ঘটল। তবে এবার দক্ষিণ গেটে নয়, উত্তর গেটে।
জগন্নাথদেবের দর্শন ছাড়াও এসময় আর একটা শিহরিত হওয়ার মতো দৃশ্য দেখা যায়। বিশাল উঁচু মন্দির শীর্ষের ধ্বজা (পতাকা) প্রতিদিন পালটানো হয় এবং সেটা এই সন্ধের সময়। এর জন্য পেশাদার লোক আছে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে যখন ওরা মন্দির শীর্ষে উঠছিল আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। যখন ওরা শীর্ষে পৌঁছে গেল, তখন ওদের অবয়ব হাতের মুঠোয় ধরে রাখার মতো। পুরোনো পতাকার খণ্ডাংশ নিলাম হয়। সেখান থেকেও জগন্নাথদেবের আয় মন্দ হয় না।
এদিন আমি আর ভিতরে গেলাম না। দলের বাকি সদস্যরা যখন মন্দির অভ্যন্তরে আমি তখন বাইরের মন্দির সংলগ্ন বাজারে ঘোরাঘুরি করছিলাম। শুনেছিলাম উত্তর গেটে খুব সস্তায় ছানা পাওয়া যায়। শান্তকে সঙ্গে নিয়ে আমি গেলাম ছানার সন্ধানে। খুঁজতে খুঁজতে একজন ছানা বিক্রেতাকে পেলাম। দু’কেজি ছানা কিনলাম। সামনেই একটা মিষ্টির দোকান, বেশ ভিড়। সুতরাং মিষ্টি ভালো হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বেশ কিছুটা ছানা-সহ মিষ্টি খেলাম। পুরীর সমস্ত মিষ্টির দোকানে ছানাপোড়া আর খাজা থাকবেই।
পরেরদিন সকালে আমাদের হোটেলের সামনে একটা পুলকার এসে দাঁড়াল। শুনলাম ওটাই আজ আমাদের বাহন। স্নান সেরে, ভারী ব্রেকফাস্ট করে বাসের পেটে ঢুকে গেলাম। আমি সোজা পিছনের সিটে। পিছনটা পুরো ফাঁকা ছিল। বাস চলল সি-বিচ ধরে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মূল রাস্তায়। পুরী ছেড়ে যাওয়ার মুখে, একজন পুলিস বাসটা দাঁড় করিয়ে উঠে এল, সঙ্গে একটি ছেলে। বাসের ভিতরে এদিক- ওদিক তাকিয়ে দু’টো ফাঁকা সিট দেখে বসেও গেল। বুঝলাম আমাদের সহযাত্রী হয়ে কিছুদূর যেতে চায়।
( চার )
আজ অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে। হোটেল থেকে বার হতে এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছিল। আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য ধবলগিরি। ছোট্টপাহাড়ের উপর মন্দির। আমাদের বাস পাহাড়ের অর্ধেকটা উঠে এল, বাকিটা হেঁটে এবং খালি পায়ে। সামনেই ধ্যানমগ্ন মহাদেবের বিশাল মূর্তি। পিছনে বুদ্ধদেবের ধ্যানগম্ভীর মূর্তি। থরে থরে সাজানো নানা স্বাদের নাড়ু। চেখে দেখার সুযোগ আছে। ইচ্ছে হলে কেনাও যায়। স্বাদ ভালোই, কাজু বাদামও প্রচুর। কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। শান্ত বলল, কোনারকে আরও সস্তা। সুতরাং ওখানেই কিনতে হবে। সে আরেক কাহিনি। যে-কাজুকাহিনি শুরু হয়েছিল কোনারকে, সে কাহিনি কোনারকে শেষ হয়নি, শেষ কথাটি লেখা হয়েছিল বাড়িতে এসে।
(ক্রমশ…)