যাইহোক, বেলা বাড়ছে। এই সবে শুরু, এরপর ভুবনেশ্বর মন্দির। কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেমে গেল। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে মন্দির দেখতে। পুরীতে এতটা গরম লাগছিল না, এখানে দরদর করে ঘাম হচ্ছে। প্রখর রোদ, পিচ রাস্তা গরমে প্রায় গলে গেছে। সবাই চলে গেল। মাথায় থাক দর্শন, একমাত্র আমি থেকে গেলাম বাসে। বাসের ড্রাইভার, হেলপার একনাগাড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে উদয়গিরি আর খন্ডগিরি না যাই। বক্তব্য, ওখানে এমন কিছু দেখার নেই। শুধু শুধু যাওয়া হবে, আর গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। রাস্তার দুধারে দু’টি পাহাড়, আর কিছু দেখার নেই। আমরা নাছোড়, তা বললে তো হবে না, আমরা যে ওই দু’টি জায়গার অনেক নাম শুনেছি। আর এসেছি যখন, না দেখে যাবই বা কেন? সে সাপ ব্যাঙ যাই হোক না কেন!

উদয়গিরি, খণ্ডগিরি এলাকা রীতিমতো জমজমাট। দোকান-পশরা নিয়ে বসেছে অনেকেই। এছাড়াও বেশ কিছু লোক কাঁচা বাদামের ঠোঙা নিয়ে ফেরি করছে। কেন না এখানে প্রচুর বাঁদর, তাদের ভেট না চড়িয়ে মন্দিরে যেতে পারবেন না। বাদাম না পেলে জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করবে। সুতরাং কেনা হল বেশ কয়েক প্যাকেট বাদাম। প্রথমে উদয়গিরি, টিকিট কেটে ঢোকা। ভিডিও করা যাবে না। তা হলে কি স্টিল ছবি তোলা যাবে? ঠিক বোঝা গেল না। এখন তো সব ফোনেই ভিডিও ক্যামেরা আছে। নয়নাভিরাম দৃশ্য, ছোটো ছোটো ধাপে উঠে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে রং-বেরঙের ফুলের সমারোহ।

উদয়গিরিতে পৌঁছে দেখি, ছোটো ছোটো অনেক গুহা। একটা বড়ো চাতাল। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখি একটা বড়ো গুহার ভেতর দু’জন মাতাজি বসে আছেন। কৌতূহলে কাছে গিয়ে দেখি, ওমা! মাতাজি কোথায়? এ তো আমাদের মিষ্টি আর মেহুলী। কী সুন্দর ভঙ্গিতে জোড় হাতে দু’জনে বসে ছিল। সেই গুহাটার মুখে বাঘের মুখ আঁকা ছিল। কেন, কে জানে। মনের আনন্দে কিছুটা ভিডিও, কিছুটা স্টিল ছবি তুললাম। এখানে দেখার কেউ নেই। খণ্ডগিরি ওঠার ধকল আর কেউ নিতে চাইল না, সুতরাং খণ্ডগিরি এবারের মতো বাদ। বাসের ড্রাইভার বেশ খুশি কিছুটা হলেও সময় বাঁচানো গেছে। বাস ছাড়ল নন্দনকাননের উদ্দেশে।

মুড়ি যখন নেওয়া হয়, তখন মনে হয় বাহুল্যমাত্র কিন্তু খিদের মুখে যেন অমৃত। কোথাও কোনও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না অথবা যা পাওয়া যাচ্ছে সেটা আর খেতে ভালো লাগছে না, তখন মুড়ি। যে বছর গ্যাংটক গিয়েছিলাম, তখন মুড়ি যে কী জিনিস বুঝেছিলাম। এখানেও বাস ছাড়ার একটু পরেই মুড়ি এল সঙ্গে চানাচুর, বাদাম। আহা, যেন স্বর্গীয় আস্বাদ! এদিকে বাস চলছে তো চলছেই। অনেকক্ষণ চলার পর, নন্দনকাননের কিছুটা আগে একটি রেস্টুরেন্টের কাছে আমাদের বাস থামল। প্রচুর ভিড়, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আমরা এখানে লাঞ্চ সারলাম।

সারাদিন বৃষ্টির পর যদি বিকেলে হঠাৎ ঝকঝকে রোদ উঠে পড়ে, দিনের পর দিন কাজ করতে করতে হঠাৎ যদি একটা ছুটি পাওয়া যায়, মেঘ না চাইতেই যদি জল হাতের নাগালে চলে আসে— আমার অবস্থাও তখন ঠিক সেরকম। ধাঁ করে উড়ে গেলাম, উড়ছি, মেঘের ঝুঁটি চেপে ধরে মেঘের সঙ্গে নীল আকাশে উড়ে চলেছি। সেই শুরু, তারপর মৌটুসি কখন যেন, আমার পরি হয়ে গেল। অফ পিরিয়ডের করিডোর কখন যেন আমাদের আগডুম বাগডুম গল্প করার পার্ক হয়ে গেল জানতেই পারিনি। হঠাৎ বাসটা ব্রেক কষায় এক ধাক্কায় কলেজের রঙিন দিন থেকে ধাঁ করে এসে পড়লাম নন্দনকাননের এবড়ো-খেবড়ো পথে! আগামীকাল আমদের ডেস্টিনেশন চিল্কা হ্রদ।

( পাঁচ )

অবশেষে নন্দনকানন। প্রতীক্ষার অবসান। চত্বরে বাস পৌঁছোতেই গাইডদের হামলা। বিশাল এরিয়া। তাড়াতাড়ি দেখে ফিরে আসতে গেলে গাইডের সাহায্য নেওয়াই ভালো, না হলে হয়তো বেশ কিছু জায়গা না দেখাই থেকে যাবে। অযথা অনেক সময় নষ্ট করে ফিরে আসতে হবে। এরকম একটা আবহাওয়া বাসচালক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। ভিতরে যাওয়ার আগেই শুনলাম, জঙ্গল সাফারি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং তারের বেড়ার এপার থেকেই দেখতে হবে বন্যপ্রাণীদের। কাচঢাকা বাসে বসে, উন্মুক্ত প্রান্তরে বন্যপ্রাণীদের স্বাধীন বিচরণ দেখার সৌভাগ্য এ যাত্রায় হল না।

এখানেও বাঁদরের উৎপাত। এবারে বাঁদরের টার্গেট লহরী। দেখা যাচ্ছে সদ্য যুবতী লহরীকেই ওদের খুব পছন্দ। বার বার ওর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে। আমাদের গাইড ছেলেটি বাঁদর তাড়ানোয় মুখ্য ভূমিকা পালন করায়, আমরা বেশ নিশ্চিন্ত। ফেরার সময় ট্রয় ট্রেন। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে খেলনার গাড়িতে যেতে বেশ ভালো লাগছিল। যখন নন্দনকানন থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখান থেকে যেতে হবে কোনারক।

কোনারকের সূর্য মন্দির, সেই ছোটোবেলা থেকে যার কথা শুনে আসছি। পাঠ্যবইয়ে, গল্পে, নানা ভাবে সূর্যমন্দির এসেছে। আর আমি ভেবেছি কবে যাব, কবে সেই বিস্ময়কে দু’ চোখ ভরে দেখব। আজ সেই দিন, আজ সেই বহু আকাঙ্খিত দিন, আজ সূর্যমন্দিরে সশরীরে। সমুদ্র থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিশাল এলাকা জুড়ে সূর্যের মন্দির। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব কারুকাজ, তৎকালীন সমাজ, অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ যার ছত্রে ছত্রে। সূর্যের রথের চাকা, নাটমন্দির পার হয়ে মূল গর্ভগৃহ। এখানেও গাইড, যার কাজ দাঁড়ি, কমা বাদ দিয়ে নাগাড়ে মুখস্থ বলা— তুমি শুনছ কিনা সেটা জানা তার কাজ নয়।

মন্দির অভ্যন্তরে সূর্যের মূর্তি। শূন্যে ঝুলছে। সামনে পিছনে, ঊর্ধ্বে নীচে, কোথাও কোনও অবলম্বন নেই। কোনও শক্তিশালী চুম্বক দিয়ে মূর্তিটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সে সময় নিকটবর্তী সমুদ্র দিয়ে কোনও জাহাজ গেলেই চুম্বকের আকর্ষণে থেমে যেত। ব্রিটিশ রাজত্বে সেই চুম্বক খুলে নেওয়া হয়। শোনা গেল, মন্দিরগৃহ বন্ধ সেও আজ ১০০ বছর হয়ে গেল। খোলার কোনও উদ্যোগ আজও কেন নেওয়া হল না এটাও একটা বিস্ময়! সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় একটা একটা করে চিত্রিত পাথরগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছিল, এখন সে সব মেরামত করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আমরা যখন কোনারক পৌঁছেছিলাম, তখন সূর্য অস্তগামী, প্রায় সন্ধে। যার জন্য সেইভাবে সূর্যমন্দির দেখা হল না। এখানে মুক্তোর মালার পশরা নিয়ে অনেকেই বসে আছে। এক একটার দাম বলছে ৩৫০ টাকা, কিন্তু বিক্রি করছে শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৫ টাকায়। মুক্তো না প্লাস্টিক, প্রশ্নটা লাখ টাকার। এখানে কাজু সস্তা, সত্যিই খুব সস্তা। সুন্দর প্যাকেটে মোড়া। খুব সুন্দর দানা। বাড়ি ফিরে বোঝা গিয়েছিল, সস্তার কতরকম অবস্থা হতে পারে। বাইরে কিছু ভালো দানা দিয়ে ভিতরে অপুষ্ট দানা ভরে দিয়েছে। সোজা বাংলায় আমাদের ঠকিয়েছে, যাচ্ছেতাই ভাবে ঠকিয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতের কাজু ক্রেতারা সাবধান। ভালো করে পরখ করে কিনবেন। ফেরার সময় রাত হয়ে গেল। টিফিন করতে হবে। বাসের চালক জানাল, সামনেই চন্দ্রভাগা সি বিচ, সেখানে কিছু দোকান আছে। তথাস্তু, ওঠো সবাই বাসে। মিনিট দশেক চলার পর পেলাম চন্দ্রভাগা।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...