তেমন কিছু নেই, সেই মিষ্টি আর ছানাপোড়া। একটা দোকানে ছানা আছে। জগন্নাথ মন্দিরে আমরা যে দামে কিনেছিলাম, এখানে একেবারে ডবল। কী আর করা যায়, তাই-ই খাওয়া হল। বাস ছাড়ল প্রায় তিরিশ মিনিট পর। বামদিকে সমুদ্রকে রেখে আমাদের বাস চলল। প্রায় নির্জন রাস্তা। আমরা যাচ্ছি, আর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। একটা অদ্ভূত অনুভূতি। বেশ কিছুটা এভাবে চলার পর, হঠাৎ একসময় দেখি সমুদ্র হারিয়ে গেছে পথের কোন বাঁকে। আমরা তখন প্রায় পুরীর কাছাকাছি।
( ছয় )
চিল্কা হ্রদ। নিবেদন যাবে না। সুনামীর আগে দেখেছে। শুনেছে সেই হ্রদ আর নেই। পূর্বের সেই মধুর স্মৃতিকে সে ধ্বংস করতে চায় না। ডাক্তারবাবু মানে সমর্পণ ওকে কিছু কাজ দিয়েছে, আমরা যখন হ্রদের জলে ভাসব নিবেদন তখন সেই কাজগুলো করবে। গোপালপুরের কাছে বারকুলি আর রম্ভা, চিল্কার অন্যদিক, অন্যরকম সৌন্দর্য। আমরা ওই রাস্তায় যাব না। পুরী থেকে সবচেয়ে কাছে সাতকুরা, সেখানেই চিক্কা। খুব বেশি হলে ৬০ কিমি।
চা-বিস্কুট খেয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। পথে কোথাও জলযোগ করা হবে। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর, একটা গঞ্জের মতো জায়গাতে আমাদের চালক তার রথ থামাল। একটা দোকান দেখিয়ে বলল, এই পথে সবচেয়ে ভালো খাবারের দোকান। দোকানটির খাবার সত্যিই ভালো। পাওয়া যায় মশলাধোসা, ডালের বড়া, কচুরি, সঙ্গে নানারকমের মিষ্টি, খাজা আর ছানাপোড়া। এটা এখানকার যে-কোনও মিষ্টির দোকানের কমন আইটেম। দোকানি জানাল, তাদের রসগোল্লাও খুব ভালো। খাওয়া হল। সত্যিই ভালো টেস্ট।
অবশেষে আমরা চিল্কার দুয়ারে। পথে কুহুর টুপি হাওয়ায় উড়ে গেল, গাড়ি থামল। টুপি উদ্ধার করতে গিয়ে একজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা হল। সে জানাল, চিল্কাতে ঝিনুক ভেঙে মুক্তো বার করে বিক্রি করে। সেই মুক্তো না কেনাই উচিৎ, কেন না সেগুলো আসল মুক্তো নয়, সব ঝুটো।
বেশ ভালো লাগছিল চিল্কায় ডলফিনের লাফালাফি। যে জায়গাতে অনেক বেশি ডলফিন, সেখানে যখন আমাদের নৌকা দাঁড়িয়ে গেল, মনে হচ্ছিল না, নৌকা আর কোথাও যাক। ডলফিনগুলো অনেকক্ষেত্রেই জোড়ায় জোড়ায় লাফাচ্ছিল। আরও এগিয়ে গেলে সি- মাউথ। সমুদ্রের মুখ, যেখানে সমুদ্র মিশেছে চিল্কায়। বিশাল বালিয়াড়ি। প্রচুর ট্যুরিস্ট, মনের আনন্দে ঘোরাফেরা করছে। আর খুব সস্তায় বিক্রি হচ্ছে গরম গরম চিংড়িমাছ ভাজা, কাঁকড়া, ডাব। আমরাও সেপথেই গমন করলাম। যার যা পছন্দ ইচ্ছেমতোন খেলাম।
দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি। অজস্র ছোটো ছোটো লাল কাঁকড়া, জেলিফিশ, মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেমন আমরা ঘুরছি। কোনও চাপ নেই, হাট-বাজার নেই, স্কুল, অফিস নেই— যেন কোনও নতুন স্বর্গে আমরা এসে পড়েছি! এই জন্যই তো বেড়াতে আসা। দু’দিনের জন্য একটা স্বর্গ রচনা। ভালোলাগা সবকিছু ফ্রেমে বন্দি করছিলাম।
আমরা নৌকাতে ওঠার আগে, একটা হোটেলে খাবার অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝারি মাপের চিংড়ির মালাইকারি, সঙ্গে সরু চালের ভাত, ডাল আর সবজি। পুরীর হোটেলের তুলনায় দাম বেশ চড়া। যে-হোটেলে কিংবা খাবার দোকানে বেশি ভিড়, সেখানে খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সেখানে আর যাই হোক বাসি পচা খাবার থাকবে না।
নৌকাবিহার করে যখন আমরা চিল্কার ঘাটে পৌঁছোলাম, তখন প্রায় ২.৩০ বেজে গেছে। রম্ভা, বারকুলিতে এখানকার তুলনায় খাবারের মান অনেক ভালো। দামও অনেক সস্তা। এ যাত্রায় রম্ভা বারকুলি যাওয়া হল না। ফেরার সময় আর এক বিভ্রাট। গাড়িতে ওঠার সময় মেহুলী দেখে তার টাকার ব্যাগ, তার কাছেই থাকার কথা ছিল কিন্তু নেই।
এবার শুরু থেকেই মেহুলীদের বিভ্রাট। ট্রেনে ওঠার সময়ে মেহুলীর চটি ট্রেনের নীচে পড়ে যাওয়া, জগন্নাথ মন্দিরে শান্তবাবুর পকেটমারি। যাইহোক শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল। গাড়িতেই পড়েছিল। এবার আমি আর সমর্পণ ড্রাইভারের পাশে, চনমন আর অরিত্র পিছনে। ফেরার পথে একটা জৈনমন্দির দর্শন করলাম, নাম অলারনাথ। সবাই মন্দিরের ভিতরে গেল, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, আরও অন্য সৌন্দর্য। সন্ধের কোলে ফিরে এলাম আমাদের হোটেলে। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সি-বিচে কাটালাম।
( সাত )
পরদিন আমাদের ফেরার ট্রেন রাত ১০.২০ মিনিটে। খুব সকালে আমরা আবার সি-বিচে। সারি সারি চেয়ার পাতা, এক কাপ চা নিলেই ওই চেয়ারের মালিকানা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের। দু’কাপ করে চা নিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। সমুদ্রকে ফ্রেমবন্দি করতে করতে যখন ঘুরছিলাম, তখন দেখা হল পৃথাদির সঙ্গে। পৃথাদি বার্ণপুরের একটা গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। নাতিকে নিয়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এলাম আমাদের দলবল যেখানে বসেছিল সেখানে। সামান্য তফাতে চোখ ফেরাতেই আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একটা টি-স্টলের পাশে চেয়ারে বসে আছে মৌটুসি— আমার পরি।
পুরী আসার পর থেকে, পরি এসেছে অনেকবার। কিন্তু এত কাছে এই প্রথম। এ যদি পরি না হয়, তাহলে অবশ্যই পরির কোনও যমজ বোন আছে। এক অমোঘ টানে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল পরির কাছে যাওয়ার জন্য আমি অনন্তকাল ধরে হাঁটছি, হেঁটেই যাচ্ছি। শেষপর্যন্ত পরির কাছে পৌঁছতে পারব তো? হ্যাঁ পারলাম, অবশেষে পরির কাছে। অনেকটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরি নির্বিষ্ট হয়ে দেখছিল সমুদ্রকে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার ছন্দকে যেন মুখস্থ করছে মনে হল। খুব ধীরে আমার দিকে মুখ ফেরাল। চোখে জিজ্ঞাসা, সে শুধু এক নিমেষের জন্য। তারপরেই পরির মুখে যে অপার্থিব আলো জ্বলে উঠল, তার বর্ণনা দেবার মতো ভাষা আমার স্টকে নেই, স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
—যাক তাহলে চিনতে পেরেছ। আমি তো ভাবলাম… আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই পরি বলে উঠল— তোমাকে চিনব না?
যেভাবে, যে-ভঙ্গিতে বলল, আমি যেন শুনলাম— অনন্তকাল পরে দেখা হলেও, এমনকী এ পৃথিবীতে না হয়ে, অন্য কোনও পৃথিবীতে দেখা হলেও তোমাকে যে চিনতেই হবে গো!
টুয়েলভের ফাইনাল পরীক্ষার পরেই পরি হারিয়ে গিয়েছিল। সেই যে শুরু হয়েছিল আমাদের মেলামেশা, তারপর স্বাভাবিকভাবেই কলেজে আমরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলাম। ক্লাসের বোর্ডে, কলেজের দেয়ালে লেখা হতে লাগল আমাদের নাম। এমনকী শহরের রাস্তায় আমাকে ধরে থ্রেট করা হল। ভাবখানা এমন— কে হে তুমি হরিদাস পাল! পাড়া গাঁয়ের ক্যাবলা! আমাদের মতো হিরোরা থাকতে, কলেজের সেরা সুন্দরীর সঙ্গে প্রেম করবে? তখন আমি কলেজের হোস্টেলে থাকি। ঘটনাটা হোস্টেলে জানাতেই সবাই খেপে লাল, পরদিন হাতের কাছে যে যা পেল হকিস্টিক, উইকেট, ব্যাট নিয়ে হইহই করে কলেজে যাওয়া হল। যারা আমাকে থ্রেট করেছিল, তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।
সমুদ্রতটের হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছিল পরির খোলা চুল। ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল পরির পায়ের পাতা। মনে হচ্ছিল পরি নয়, পরির সুষমা আমার সামনে। সেদিন দেখেছিলাম সাহস, যেদিন আমরা দলবল মিলে কলেজে ঢুকেছিলাম, তার পরের দিন থেকে। এমন শান্ত, সুন্দরের মধ্যে কোথায় এত সাহস লুকিয়ে ছিল? পরের দিন কলেজ ক্যাম্পাসে আমার হাত ধরে ঘুরেছিল। সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।
—কবে এলে পরি?
যেদিনের কথা পরি বলল, সেদিনটা আমাদেরও আসার দিন ছিল। একই ট্রেনে এসেছিল। আমি স্টেশনে যাকে দেখেছিলাম, সে-ই পরি ছিল।
—কবে ফিরবে?
পরি জানাল, আর দু’দিন তারা থাকবে। ওর কলেজের মেয়েদের নিয়ে এসেছে, শিক্ষামূলক ভ্রমণে।
ইস, আমরা যে আজ রাতেই…। ভাবলাম যদি থেকে যাই আর দু’দিন। না, না, সেটা ঠিক হবে না। লোকে কী ভাববে? এত সাহস আমার নেই। পরির মতো সাহস আমার কোনওদিনই ছিল না। ও হোস্টেলে এসে অসুস্থ আমাকে দেখে যেতে পারে। ওদের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে। আমি এসব কিছু পারি না। আমাদের সম্পর্কটা কী ছিল, এতদিনেও তো বুঝতেই পারলাম না। পরি আমার কে ছিল? শুধুই বন্ধু নাকি অন্য কিছু? তবে এটুকু জানি, পরিকে আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। কোনওদিন না। চলে তো যেতেই হবে।
জিজ্ঞেস করি আবার কবে, কবে দেখা হবে পরি?
পরি একটু হেসে বলে, হবে হয়তো, এমনি করেই কোনও একদিন। আর দেখা যদি আর কোনওদিন না হয়, তাতেই বা কী রাজা।
হ্যাঁ, বলা হয়নি পরি আমাকে রাজা বলত। ততক্ষণে ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। ফিরে যেতে হবে হোটেলে। আমি শেষবারের মতো পরির দিকে তাকালাম! না ভুল বললাম, পরির দিকে নয়, পরির চোখের দিকে। যেতে হবে পরি, জানি না আর কোনওদিন দেখা হবে কিনা! কিন্তু না থাক, সব কথা তো উচ্চারণ করে বলা যায় না। সে কথা অন্য কারওর শোনার দরকারও নেই।
অকারণেই ডেকে উঠি পরি। পিছু ফিরলাম। জানি না, পরির চোখটা ভিজে গিয়েছিল কিনা! তবে আমার চোখটা শুকনো ছিল না।
কতবার তো কত কত জায়গাতে বেড়াতে গেছি, কোনওদিন দেখা হয়নি। পুরীতে এসে কেন পরির সঙ্গে দেখা হল? না দেখাই তো ভালো ছিল। ছিল কি? না সেটাও জানি না। আমি হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কোথাও, কোনও একদিন আবার দেখা হয়ে যাবে।
(সমাপ্ত)