দেখুন, আমি কলকাতায় থাকি। উনি আমার বড়ো বউদি হন। ওনার ছেলেকে আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি। তাই যোগাযোগও নেই। আমেরিকায় থাকে শুনেছি। এমনকী আমার বাবার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত আমার দাদাকে এই বউদি আসতে দেননি। এমনকী এখানে আমাদের অনেক পৈত্রিক জমি-জমা আছে, কিন্তু এই বউদির অসহযোগিতার জন্য সেই জমি-জমা বিক্রিও করা যাচ্ছে না। পড়ে পড়ে অযত্নে নষ্ট হচ্ছে। চিরকালই ওনার টাকা পয়সার অহংকারের জন্য উনি আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগই রাখতেন না।

—দেখুন, এখন ওসব ভাবার সময় নয়। ভদ্রমহিলা এখন মৃত্যুশয্যায়, তাই যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়। মানবিকতার কথা ভেবে অন্তত…! ওহো আপনার নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

—শম্পা মণ্ডল। ঠিক আছে আপনি যখন মানবিকতার কথা বলছেন তখন আমি চেষ্টা করব যতটুকু করা সম্ভব তা করার। তবে আমি দিল্লি গিয়ে ওনাকে দেখাশোনা করতে পারব না। আমিও এখানে একা থাকি। আমার স্বামী গত হয়েছেন দু’বছর হল। আমার দুই মেয়ে আছে তারা বিবাহিত এবং বিদেশে সেটেলড। তাই আমাকেও এখানে দেখার কেউ নেই।

—দেখুন ওনার দেখাশোনার জন্য এজেন্সির মাধ্যমে একজন পরিচারিকাকে ২৪ ঘণ্টার জন্য রেখেছি। তাকে মাসে ২৫ হাজার টাকা করে দিতে হবে।

—আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। ঠিক আছে আমি এই খরচটা দিয়ে দেব। ওনার বিলটা আমাকে পাঠিয়ে দেবেন।

—টাকাটা আমাদের দিতে হবে না। যে এজেন্সি লোক দিয়েছে তাদের দিয়ে দিলেই হবে।

এরপর আরও দেড় মাস কেটে গেছে। অনিতাদেবীর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হয়েছে। মিস্টার আহুজা আমেরিকাতে ওনার ছেলের নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলেন। তাতে রিপ্লাই এসেছে, অনিতা সরকারের ছেলের বউ লিখেছে— আমি একজন আমেরিকান লেডি। আমার স্বামী অনিন্দ্য সরকার এখন জেলে আছে। সামনের মাসে কোর্টের তারিখ আছে। তখন জানতে পারব উনি ছাড়া পাবেন কিনা! নয়তো দশ বছরের জেল হবে। আর বিস্তারিত কিছু লেখা ছিল না। সদুত্তর না মেলায় সমস্যা আরও বেড়ে গেল।

ডাক্তার দেখতে এসে বললেন— ইমিডিয়েট রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। না হলে বাঁচানো যাবে না। তাই সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শম্পা মণ্ডলের থেকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য অনুমতি চাওয়া হল। কিন্তু উনি রাজি হলেন না।

শম্পা বললেন— দেখুন, আমি অনুমতি দিলেও ওনার ছেলে পরে আমাদের বলতে পারে যে, কোন অধিকারে আমরা ওনাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। দ্বিতীয়ত, নার্সিং হোম বা হাসপাতালের এত খরচা আমরা দিতে পারব না। আপনারা যা ভালো মনে হয় করুন।

অনিতা সরকারের অবস্থা আরও খারাপ হওয়াতে আরডব্লিউএ পুলিশের সহায়তা নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করল। কিন্তু তিনদিনের মধ্যে উনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন।

বিনোদ বললেন— ওনার ছেলেকে ফোন করেছিলাম। ওনার আমেরিকান বউমা জানিয়েছেন ওদের ছেলেকে পাঠাবেন। তবে যতক্ষণ ছেলে এসে না পৌঁছোচ্ছে ততক্ষণ আমাদের দায়িত্ব যে, ফ্ল্যাটটা যেন কেউ বেদখল করতে না পারে।

সৌমিত্রবাবু বললেন— সে কী! এ কীভাবে সম্ভব?

পাশ থেকে মিস্টার নায়ার বলে উঠলেন— আমাদের পাড়াতেই এমন হয়েছে। মিস্টার মুখার্জীর ফ্ল্যাটও একজন পরিচারিকা জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিল। ওনার ছেলে-মেয়ে কেউ ছিল না। বউদি আগেই মারা গিয়েছিলেন। এক পালিতপুত্র ছিল কিন্তু সেও শেষ সময়ে আলাদা থাকত বলে একজন পরিচারিকা রেখেছিলেন। সেই পরিচারিকা এবং তার স্বামী জোর করে তাকে সম্পত্তি সই করিয়ে নিয়েছিল।

সৌমিত্র— আরে মশাই, সেখানে তো ওনার নিজের সই ছিল বলে সবাইকে মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু এখানে তো অবস্থাটা অন্যরকম।

মিস্টার আহুজা বললেন— সৌমিত্রবাবু আপনি হয়তো জানেন না আমাদের এই পাড়াতে মা ও মেয়ে থাকতেন। ভদ্রমহিলা মারা যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ওনার মেয়েও মারা যান। তখন আমাদের আরডব্লিউএ থেকে তার কিছু আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা জানান যেহেতু মা এবং মেয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না তাই তাদের সম্পত্তি নিয়ে কারও কোনও উৎসাহ নেই। তখন আরডব্লিউএ থেকে ওই ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর এই পাড়ারই এক ঝগড়াটে মহিলা একথা জানতে পেরে তালা ভেঙে ফ্ল্যাটে ঢুকে ফ্ল্যাট দখল করে নেয়। প্রতিবাদ করলে বলে যে, কোনও তালা লাগানো ছিল না। তাই সে ফ্ল্যাটটির কব্জা নিয়েছে।

—এও কি সম্ভব?

—সব সম্ভব দাদা। কোর্টে গেলেও ওরা বলবে তদেরকেই ফ্ল্যাটটা দিয়ে গেছে। কোনও প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। এখনও তারা ওই ফ্ল্যাট দখল করেই আছে। তাই আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি হোক। আগামীকাল আমেরিকা থেকে অনিতাদেবীর নাতি এলে ফ্ল্যাট ওনার হাতে তুলে দিয়ে আমারা নিশ্চিন্ত হব!

পরেরদিন আমেরিকা থেকে নাতি এসে উপস্থিত হলে, মি. আহুজা অনিতাদেবীর অস্থি নিয়ে ওনার নাতিকে নিয়ে হরিদ্বার গিয়ে পারলৌকিক কার্য সম্পন্ন করে ফিরে আসেন।

ছেলেটি পুরোপুরি আমেরিকান। বাংলা বা হিন্দি বলতে পারে না। ভাষা সমস্যা থাকায় কষ্ট করে কোনওরকমে কাজটা সম্পন্ন করা হয়। সে ফেরার টিকিট নিয়েই এসেছিল, তাই ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক-এর কাগজপত্র ইত্যাদি নিয়ে আমেরিকায় রওনা দেয়।

এখানেই হয়তো গল্পটার সমাপ্তি হয়ে যেত। কিন্তু কথায় আছে— ম্যান প্রোপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস।

পরেরদিন মিস্টার আহুজা ফোন করে সৌমিত্রবাবুকে জানালেন— দাদা সব গড়বড় হো গ্যায়া। আজ আমরিকা সে উনকা নাতি কা ফোন আয়া থা, উনহো নে বোলা কী কাল ও আ রাহা হ্যায়। অভি সওয়াল এ হ্যায় কী— কাল যো সব লেকে গায়া, ওহ ফির কউন থা!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...