সাত-সকালে একটা খবর শুনে মাথা গরম হয়ে গেল বিদিতার। সবসময় মহিলাদেরই কাঠগড়ায় তুলে কেন যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এটা দেখেই রাগ দ্বিগুন হল বিদিতার। তার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল, আশ্রমের সাধুরা যা ঘটাচ্ছে, তা কি কোনও নতুন ঘটনা? রাতারাতি তো আর আশ্রমও গড়ে ওঠেনি এবং সেখানে সাধুদের দৌরাত্ম্যও নতুন কোনও ঘটনা নয়। যাইহোক এ-সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মাথা যখন আরও গরম হয়ে উঠল, তখন টিভির সুইচ অফ করে দিল বিদিতা। তারপর মনকে শান্ত করার জন্য রান্না ঘরে গেল চা বানাতে। কিন্তু চা বানাতে গিয়ে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও, মন ডুব দিল স্মৃতির গভীরে। শতকোটি চেষ্টা করেও মন খারাপের সেই স্মৃতিকে তাড়াতে পারল না বিদিতা।

অবশ্য মনকে আয়ত্তে আনতে না পারার ঘটনা নতুন নয়। আগেও বিদিতা বহুবারই পুরোনো দিনের কথা ভেবে মন খারাপের শিকার হয়েছে, কষ্ট পেয়েছে। আজও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটল।

আজ আবার মাসির কথা মনে পড়ে গেল। মা আর মাসি যখন কথা বলত, তখন আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে হতো। মাসি বলত, বড়োদের কথা শুনতে নেই বাচ্চাদের। বাধ্য হয়ে আমি তখন চলে যেতাম অন্যত্র। কিন্তু তারই মধ্যে যতটুকু যা কথা কানে আসত, তাতে মনে হয়েছিল, মাসি ছিলেন বাল্যবিধবা। তবে তখন ‘বিধবা’ শব্দটা শুনলেও, সঠিক মানে বুঝতাম না। তাই, মা-কে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম যে, মাসি যখন ছোটো ছিল, তখন মেসো মারা গিয়েছিলেন। অবশ্য পুরো বিষয়টা বুঝেছিলাম আরও বড়ো হয়ে।

অনেক বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছিল মাসির। বিষয়-সম্পত্তিও ছিল অনেক। কিন্তু মেসোর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন মেসো। খুব আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মাসির থেকে মেসো বয়সে অনেকটাই বড়ো ছিলেন। মেসোকে সুস্থ করে তোলার জন্য তাদের বাড়িতে পুজোপাঠ চলত। বৃন্দাবন থেকে এক গুরুজি আসতেন বাড়িতে। তাঁর আদেশ মানতে হতো পরিবারের সব সদস্যকে। গুরুজিকে ‘ভগবান’-এর মতো মনে করা হতো।

মাসি সব রকম নিয়মনিষ্ঠা পালন করতেন মেসোকে সুস্থ করে তোলার জন্য। শুনেছি একবার এক শীতের রাতেও নাকি স্নান করে রাতভর কীসব নির্দেশ পালন করেছিলেন মাসি। সব তিনি মুখ বুজে করতেন। কিন্তু কোনও সেবাযত্ন, নিয়মনিষ্ঠা, পুজোপাঠ করেও মেসোর প্রাণরক্ষা হয়নি।

মাসির বৈধব্যের পর অনেকেই অনেক জ্ঞান, উপদেশ প্রভৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। কেউ বলেছিলেন, ‘বাকি জীবন নিষ্ঠার সঙ্গে বৈধব্য পালন করে পুণ্য অর্জন করো।’ কেউ আবার সহানুভূতি দেখিয়েছিল এই বলে যে, ‘এত কচি বয়েস, আবার বিয়ে করে আনন্দ করো।’ কিন্তু গুরুজি বলেছিলেন, “একে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করো, ভালো থাকবে’ এবং তাঁর নির্দেশই পালন করতে শুরু করেছিলেন মাসি।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, বৃন্দাবন থেকে গুরুজি ডেকে পাঠালেন মাসিকে। তখন পরিবারের লোকজন আর প্রতিবেশীরা অনেকেই গুরুজির ডাকে সাড়া দেওয়ার পরামর্শ দিল মাসিকে এবং মাসিও সেই আজ্ঞা পালন করলেন মাথা নত করে।

এরপর শুরু হয়েছিল মাসির বৃন্দাবন-কাহিনি। শ্বশুরবাড়িতে তো টাকার অভাব ছিল না, তাই বৃন্দাবনে ‘ভগবান’ সেবা করতে গিয়ে অন্য বিধবাদের মতো ভিক্ষেবৃত্তি করতে হয়নি। বরং মাসির দেওয়া টাকায় গুরুজি বৃন্দাবনের আশ্রমকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তাই, থাকার জন্য ভালো জায়গাও পেয়েছিলেন মাসি। প্রথম দিকে দু’একবার শ্বশুরবাড়িতে এলেও পরের দিকে আর বৃন্দাবন ছাড়েননি মাসি। তবে আমার মায়ের সঙ্গে মাসির কথা হতো মাঝেমধ্যে ফোনে। কিন্তু, দু’একবার দেখেছি, মাসির সঙ্গে কথা বলার পর মা কেমন যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। একবার তো এমনই হল যে, মা বৃন্দাবন যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু আমার ভাই ছাড়ল না মা-কে একা। মায়ের সঙ্গে ভাইও বৃন্দাবন গেল মাসির আশ্রমে।

মা আর ভাইকে দেখে মাসি খুশি হলেও, সবকিছু দেখেশুনে আমার ভাই গেল বিগড়ে। মাসিকে সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা, ঘৃণা করতে শুরু করল। মা যখন ভাইকে বলেছিলেন মাসিকে প্রণাম করতে, ভাই তখন রেগে আশ্রমের বাইরে চলে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই ঘটনার রেশ গড়িয়েছিল বাড়ি পর্যন্ত।

আসলে আমার মা তার বোনকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, মাসির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ শুনতে চাইতেন না। তাই আমার ভাই যখন বাড়ি এসে রাগের মাথায় মাসিকে ‘বৃন্দাবনের বেশ্যা” বলে গালি দিয়েছিল, মা তখন ভাইয়ের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে বলেছিলেন, ‘গুরুজনদের সম্মান করতে শেখো।’ কিন্তু আমার ভাই তাতে এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বলেছিল, ‘আমি যা দেখে-শুনে এলাম তা কি সব মিথ্যে?” তবে আমার মা-ও ছিলেন বক্তব্যে অবিচল। তিনি ভাইকে বলেছিলেন, “তুই যা জেনেছিস, সব ভুল, মিথ্যে। আর কোনওদিন যদি আমার বোনের সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলিস তো আমার অন্য রূপ দেখবি।”

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...