সেদিন মা এবং ভাইয়ের অমন ঝগড়া দেখে আমিও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক এমন সময় মাসির ফোন এল। মা তখন রাগের মাথায় মাসিকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘যা শুনছি তা কি সত্যি? তুমি কি সম্মান হারিয়েছ?’
মায়ের কথা শুনে মাসি বলেছিলেন, ‘এখন এসব কথার উত্তর খুঁজতে গিয়ে লাভ কী? পরিবারের লোকজন, সমাজ— সবাই মিলে যখন গুরুজির আশ্রমে এই সুদূর বৃন্দাবনে আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তখন কি কেউ আমার ভালোমন্দের কথা চিন্তা করেছিল? আমার যে সম্মানহানি হতে পারে, তা কি তখন কেউ ভেবেছিল? সবই কি আমার দোষ? আমার ইচ্ছেতে কি সবকিছু চলেছে? যা ঘটেছে কিংবা ঘটে চলেছে, তার জন্য কি আমি-ই দায়ী?’ মাসির থেকে অমন কথা শুনে মা তো রেগে আগুন। বলেছিলেন, ‘এমন জীবনের কী দাম! এর থেকে তো মরা ভালো।’
মায়ের কথার উত্তরে মাসি বলেছিলেন, ‘মরে যাওয়া কি অতই সোজা! সবার কি অত মনের জোর আছে?’ এভাবেই আরও কিছু কথা কাটাকাটির পর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে মাসির যোগাযোগ।
এরপর সময়ের স্রোতে বয়ে গেছে সবার জীবনের অনেক ক’টা বছর। আমার মায়ের সঙ্গে মাসির যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নই ছিল। হঠাৎ দিল্লির এক হাসপাতাল থেকে একটা ফোন এল। জানা গেল, মাসি ক্যান্সারে আক্রান্ত। লাস্ট স্টেজ। চিকিৎসা চলছে। শেষবেলায় মাসি মায়ের সঙ্গে দেখা করার কাতর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সবকিছু জানার পর আমার মা পুরোনো মান-অভিমান ভুলে দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ভাইও কী ভেবে যেন সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে মাকে নিয়ে দিল্লি পাড়ি দিল।
মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, দিল্লি গিয়ে মা দেখে যে, মাসির সেই সুঠাম চেহারা ভেঙে জীর্ণকায় রূপ নিয়েছে। মুখোমুখি হওয়ার পর দু’জনে গলা জড়িয়ে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। দুই বোনের অমন ভাব-ভালোবাসা দেখে আমার ভাইও কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম।
কিন্তু কান্নাকাটির পর মাসি হঠাৎ মাকে বলেছিলেন, ‘আর তো ক’টা দিন আছি এই পৃথিবীতে। তাই কোনও কথা আর গোপন রেখে মরতে চাই না। কী জানার আছে বল। আমি সব বলতে চাই আজ।’
এমন অবস্থায় মাসিকে শান্ত হতে বলেছিলেন আমার মা। কিন্তু মাসি থামেননি। প্রশ্ন করার আগেই অতীত তুলে ধরেছিলেন তিনি।
মাসি সেদিন মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘শোন মিনতি, একা একটা মেয়ের বেঁচে থাকা বড়ো কঠিন রে। এটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার আগেই নিজেকে বদলে নিয়েছিলাম। যখন দেখেছিলাম, বাপেরবাড়ির কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কেউ-ই আমার দায়িত্ব না নিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দিল, তখন আমি মনকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, ঝড়- ঝাপটা যাই আসুক না কেন, সব সামলাব শক্ত হাতে।’
‘অবশ্য এই লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল আরও আগে থেকেই। স্বামীকে বাঁচানোর জন্য কতগুলি অন্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ যখন ভণ্ড গুরুজির সেবা করতে বাধ্য করেছিল, সেই তখন থেকেই আমার কপাল পুড়তে শুরু করেছিল। আমার সতীত্ব হরণ হয়েছিল তখনই। তাই বৃন্দাবনে গিয়ে নতুন করে আর খারাপ হতে হয়নি।’
‘অতএব বেঁচে থাকার জন্য গুরুজির দয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা ছিল না আমার কাছে। আর আমি জানি যে, বিধবা এক মহিলা বাড়ি ছেড়ে বৃন্দাবনের আশ্রমে থাকলে, তাকে সমাজ বেশ্যা-ই তো বলবে। অথচ সেই সমাজই রক্তচক্ষু দেখিয়ে এই বিধবাকে গুরুজির পায়ে সমর্পণ করেছিল। শালীনতা রক্ষা করা কি শুধু নারীর দায়িত্ব, কর্তব্য?’ এক নিশ্বাসে জীবনের গোপন ঝাঁপি খুলে দিয়ে মাসি তার বোনের কোলে এলিয়ে দিলেন শরীরটাকে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার ভাই সব শুনছিল। সব শুনে মাসির প্রতি সমস্ত ঘৃণা যেন মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু সে যখন মাসির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল, তখন মাসি ইহজগৎ ত্যাগ করেছিলেন।
(সমাপ্ত)