শাওয়ারের নবটা কী অদ্ভুত রে বাবা! টুম্পা বারকয়েক কসরত করে তবে খুলতে পারল। ঝপ করে ঢলঢলে ম্যাক্সিটা খুলে ফেলতেই সামনের দেয়াল জোড়া আয়নায় নিজের শরীরের ছবি ফুটে উঠল। ঘাড়ে আর বাঁদিকের বুকের উপর স্পষ্ট দাঁতের দাগ লাল টসটসে হয়ে আছে… শাওয়ার জলের ছোঁয়া লাগতেই কী ভীষণ জ্বালা করে উঠল! মনে মনে একটা বাছা খিস্তি দিল টুম্পা ওরফে লহরী…. ওই তারকেশ্বর গুপ্তা লোকটা বড্ড হারামি। মাত্র দশহাজারে রাজি হওয়াই ভুল হয়েছিল!
চুলে শ্যাম্পু ডলতে ডলতে কাল রাতের চিলি চিকেনের বিশ্রী একটা টক ঢেঁকুড় উঠল। দুর্গন্ধে ভরে গেল মুখটা। গলায় আঙুল দিয়ে বেশ খানিকটা টক জল তুলতে গিয়ে উঠে এল বদহজম হওয়া বাটার নানের টুকরো, শশা কুচি, পেঁয়াজ…। দরজায় কেউ ঘন ঘন বেল বাজাচ্ছে। কে হতে পারে? অবিনাশ বলে লোকটা বড্ড ছুঁকছুঁক করছিল, ওই বোধহয়। ভেজা শরীরে নাইটিটা গলিয়ে টুম্পা বেরিয়ে এল।
—কি ম্যাডাম রেডি তো? চ্যাটচ্যাটে দৃষ্টি নিয়ে অবিনাশ গুপ্তা কথা ক’টা ছুঁড়ে দিল।
—রেডি? বলেন কী, সবে তো ন’টা বাজে!
—তারক বলেনি? পুনম? আজ দশটায় বেরোতে হবে।
—দশটায়? আমার রেডি হতে একটু তো টাইম লাগবে।
—হা হা! টাইম লাগান কিন্তু একটু জলদি।
দ্রুতগতিতে মেকআপ করেছিল টুম্পা, এর মধ্যে অবশ্য পুনম একবার ফোন করেছিল। কাল রাতে নাকি দীপ্তি আর ওকে কুলবিন্দর এবং নৌশাদ বহুত মাল খাইয়েছিল, তাই আর বলে রাখতে পারেনি টুম্পাকে সকাল দশটার কথা। সাদা একটা লং স্কার্ট আর লাল অফ শোল্ডার টপ পরে তৈরি হয়ে নিয়েছে টুম্পা। চুলে হেয়ার জেল ঘসে সানস্কিন ঘষতে ঘষতেই তারকেশ্বর ঢুকল। লোকটার বড্ড খাই খাই… মিনিট দশেক পরে ধামসে যখন বিদেয় হল, টুম্পার ততক্ষণে অনেকটা লেট হয়ে গেছে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে বেরোতে দেখল, মোটামুটি সব্বাই হোটেলের লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে আছে— পুনম, দীপ্তি, কুলবিন্দর, নৌসাদ, তারকেশ্বর, অবিনাশ সবাই। আজ চিলকা যাবার কথা। নৌকায় মদ আর ভাড়াটে মহিলা! দিব্যি জমে উঠবে মস্তি!
ভুবনেশ্বরের আশপাশটা ঘুরে দেখছিল দলটা। দল আর কই? চারটে আধবুড়ো রইসের সঙ্গে তিনটে ছুকরি। নন্দনকানন দেখার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি টুম্পার, সেই কবে বাবা মায়ের সঙ্গে বাসে করে এসেছিল পুরী। বাসটা নন্দনকানন, চন্দ্রভাগা, খণ্ডগিরি, উদয়গিরি পাক মেরে পুরী ঢুকেছিল মনে আছে। টুম্পা তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভে—টাইভে পড়ে, খুব ইচ্ছে করেছিল নন্দনকাননটা ভালো করে দেখার… হয়নি। ওই বুড়ি ছুঁয়েই ফিরতে হয়েছিল।
কাল রাতে যখন তারকেশ্বর ওর শরীরের দখল নিয়েছে, চেটে দেখছে ওকে, তখন লোকটাকে আব্দার করে বলেছিল নন্দনকানন দেখতে চায়। লোকটা যখন আনন্দে মশগুল, চাইলে গোটা তাজমহলটা টুম্পার পায়ে ভেট দিতে পারে! —নন্দনকানন? বাঘ দেখবি তু? সাদা বাঘ? দেখ না মুঝে! অ্যায়সা বাঘ থোরেই মিলেগী তুঝে?
পানবাহার মাখানো খরখরে জিভের স্পর্শ নিতে নিতে টুম্পা অপেক্ষায় ছিল।
ঘেন্নায় থুতু ফেলতে ইচ্ছে করেছিল টুম্পার! শালা তুই বাঘ? কুত্তার অধম। বউ বাচ্চা থাকতে পয়সা দিয়ে মেয়ে ভাড়া করিস! শরীরটা রগড়ে রগড়ে ধুতে ধুতে পলাশের কথা একঝলক মনে পড়ে গেছিল।
আহা! শরীরের সুখ কানায় কানায় উপচে পড়ে পলাশের চওড়া বুকে মুখ গুঁজে দিলে। কামড়ে আঁচড়ে টুম্পা তখন যেন এক কুক্কুরী।… শরীরে হ্যান্ড শাওয়ারের জল ছেটাতে ছেটাতে টুম্পার পলাশকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, পিষে ফেলতে ইচ্ছে করে দুই জঙ্ঘার মদীর উপত্যকায়।
যাইহোক, লোকটা কথা রেখেছে। নন্দনকানন সত্যিই এসে পড়েছে টুম্পা। ঢোকার আগে একটা নামী রেস্টুরেন্টে ভরপেট গিলেছে ওরা। ঠিক তখনই ওদের দেখতে পেয়েছে টুম্পা। লম্বা পেটানো চেহারার একটা লোক, সঙ্গে ফর্সা টুকটুকে গোলগাল একটা বউ আর একটা বছর বারোর ছেলে। কোণের দিকের টেবিলে বসে খাচ্ছে। টুম্পার অম্বলের ধাত আছে। বাইরের খাবার কোনওকালেই সহ্য হয় না। কিন্তু উপায় কী? ক্লায়েন্টদের পয়সায় ভালোমন্দ ফুঁসে নেওয়াই নিয়ম এখানে। এই এখন যেমন পুনম দীপ্তিরা হাঙরের মতো গিলছে মটন রেজালা, চিকেন রেশমি কাবাব আর ফুল প্লেট বিরিয়ানি। টুম্পা একটা মিক্সড ফ্রায়েড রাইস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে দেখে কুলদীপ ইচ্ছে করে বাঁদিকের বুক ছুঁয়ে মুচকি হাসল।
—কী হল জানেমন? খানা আচ্ছা নেহি কেয়া?
—না! না! ঠিক আছে।
টুম্পার আনমনা ভাব দেখে পুনম বলল,
—কী রে! এত কী ভাবছিস শালি? বাঘের সঙ্গে শুবি নাকি?
—হামি টাইগারের থেকে কিছু কোম আছে নাকি। নৌশাদের গলায় নোংরা কথার তুফান উঠে হাসির হররা ছিটিয়ে যায় চারপাশে।
ঠিক তখনই বউ-বাচ্চাওলা লোকটা ঘুরে তাকায় এই টেবিলের দিকে। চোখে রাজ্যের ঘেন্না ফিসফিস করে কিছু একটা বলে বউটা। লোকটা চোখ সরিয়ে নেয়। টুম্পার মনটা অকারণেই নিভে আসে। একটা ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ছেঁড়া কয়েকটা পাতা বাতাসে ভাসতে থাকে।
সুরজিৎ যদি সেদিন বাস অ্যাকসিডেন্ট-এ মারা না যেত, তবে তিতলি আর টুম্পাও কি এমন করে বেড়াতে আসতে পারত? একচিলতে হাসি খেলে যায় টুম্পার ঠোঁটে। সুরজিৎ বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাবানগুঁড়ো বেচত, গালভরা নাম ছিল সেলস পার্সন! মাস মাইনের তিন হাজার টাকায় সে কী টানাটানি! ভাবলে এখনও গায়ে জ্বর আসে। সেই লোক ওদের মা-মেয়েকে বেঁচে থাকলেও কি বেড়াতে আনতে পারত? যত্তসব!
চিলি চিকেনের টুকরোগুলো কাঁটা চামচে গেঁথে মুখে চালান করতে থাকে টুম্পা। পলাশের সঙ্গে অবশ্য ঘর বাঁধার কথা ভুলেও ভাবে না টুম্পা! অনেক ঘাটের জল খেতে খেতে টুম্পা বুঝে গেছে তেষ্টার জল ঘরের কোণে ঘড়ায় তুলে রাখতে হয়, দোরগোড়ায় পুকুর কাটলে চলবে না। পলাশের সঙ্গে সম্পর্কটা তাই আজ পাঁচবছর টিকে গেছে একরকম, মা যতই গজগজ করুক টুম্পা পলাশকে ছাড়বে না! হোক না ছেলেটা বেকার! টুম্পার নিজের তো শখ আহ্লাদ আছে!
নন্দনকাননের ভিতরে ঢুকতেই গাইডরা ছেঁকে ধরে। দরদস্তুর করে একজন গাইড নেয় দলটা। টুম্পা গাইডের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে, মেয়েটার জন্যে খুব মন খারাপ করে যদিও। খানিকটা হেঁটেই পুরো দলটা ছিটকে যায়। ছোটো ছোটো কয়েকটা বসার জায়গা আছে এ—ধার ও—ধার। তারই একটায় জমিয়ে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। পুনম, পিঙ্কি আর চারটে মর্দা ওখানেই সেঁটে যায়৷ টুম্পা গাইড জগন্নাথের সঙ্গে কুটুস কুটুস করে কথা চালাতে চালাতে একে একে দেখে নেয় সাদা বাঘ, হাতির বাচ্চা, কুমিরের পাল, কতরকম পাখি… জগন্নাথ ওর উৎসাহ দেখে বলে—মাইজি, চলো চলো আরও দিখাব।
অসীম উৎসাহ নিয়ে এগোতে থাকে টুম্পা। মনে মনে ভাবে আর কয়েকটা এমন পার্টি পেলেই মেয়েকে নিয়ে পুরী আসবে একবার। এবার তো জগন্নাথ দর্শন হল না, পরের বার মাকে সঙ্গে আনবে। বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে বহুকষ্টে মা তাকে আর তার ভাইকে বড়ো করেছিল।
(ক্রমশ…)