শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশুর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অটুট বন্ধন। মাতৃস্নেহ সেই বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। কীভাবে যেন শিশুও বুঝে যায়, মায়ের কোমল স্পর্শেই সে সব থেকে বেশি সুরক্ষিত।
শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার সুরক্ষার পুরো দাযিত্ব মা নিজের হাতে তুলে নেয় এবং দায়িত্ব সামলাতে সামলাতেই শিশুর প্রতিটি প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে মা তার সন্তানকে সবদিক থেকে সুরক্ষা দিতে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। স্নান করানো থেকে শুরু করে তাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, ব্যথায় স্নেহের প্রলেপ লাগানো— সবই মা নিজের দায়িত্ব মনে করে পালন করেন।
খাওয়া, ঘুম বাদ দিয়েও সর্বক্ষণের জন্য মায়ের নজর থাকে সন্তানের দেখভালের উপর। অতিরিক্ত গরমে শিশুর যাতে কষ্ট না হয় কিংবা খেলনা নিয়ে খেলতে গিয়ে দুধের শিশু যাতে নিজের কোনও ক্ষতি না করে ফেলে, সেই ব্যাপারে মায়ের সজাগ দৃষ্টি থাকে। বাচ্চা কাঁদলেও মা-কেই বুঝে নিতে হয় সুবিধা-অসুবিধা।
বাচ্চার সুরক্ষার পুরো দায়িত্ব মা নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং দাযিত্ব সামলাতে সামলাতেই শিশুর প্রতিটি প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে মা তার সন্তানকে সবদিক থেকে সুরক্ষা দিতে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। বাচ্চা মানুষ করতে একজন নতুন মা কীভাবে নিজের কনফিডেন্স গড়ে তুলতে পারেন, রইল সেই পরামর্শ।
শিশুর স্নানের সময়
অনেক সময় বাচ্চাকে প্রথমবার স্নান করাতে মা ভয় পান। কিন্তু যদি সাবধানতা অবলম্বন করা হয় এবং স্নান করাবার সঠিক পদ্ধতি জানা থাকে, তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
স্নান করাবার সঠিক পদ্ধতি
O বাথটাবে বাচ্চাকে স্নান করানো উচিত। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, টাব-এর গভীরতা যেন কম থাকে
O বাচ্চাকে স্নান করাবার সময় ঈষদুষ্ণ জল স্নানের জন্য ব্যবহার করুন। নিজের কনুই জলে ডুবিয়ে আগে দেখে নিন জল ঠান্ডা না গরম। জল যদি সহনশীল হয়, তাহলে বাচ্চাকে ওই জলে স্নান করাতে পারেন
O প্রথমে বাচ্চার উপর জলের ছিটে দিন। প্রথমেই মগে করে মাথায় জল না ঢেলে, হাতে-পায়ে ধীরে ধীরে ঢালুন
O বাচ্চাদের জন্য তৈরি প্রোডাক্টস-ই ব্যবহার করুন বাচ্চাকে স্নান করাবার সময়
O বাচ্চার কানে বা নাকে যাতে জল না ঢোকে, তারও খেয়াল রাখতে হবে
O বাচ্চার মাথায় এক নাগাড়ে সোজা করে মগ থেকে জল ঢালবেন না। এতে বাচ্চার নরম মাথার তালুতে আঘাত লাগতে পারে
O স্নানের পর নরম তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে শিশুর ত্বক শুকিয়ে নিন। তোয়ালে দিয়ে রগড়াবেন না। ত্বক শুকিয়ে গেলে লোশন লাগিয়ে দিন।
বাচ্চা বেশি কাঁদলে
অনেক সময় বাচ্চা কাঁদতে থাকলে চুপ হতে চায় না কিছুতেই। মা-ও অনেক সময় কান্নার কারণ বুঝতে পারেন না। বাচ্চা যদি ৩ মাসের থেকে ছোটো হয়, তাহলে কারণ ছাড়াও বাচ্চা কাঁদতে পারে। সেই সময় বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটু ঘুরলেই বাচ্চা আরাম পায় এবং চুপও হয়ে যায়। কিন্তু যদি শিশুটি চুপ না করে, তাহলে বুঝতে হবে তার অন্য কোনও সমস্যা হচ্ছে। যেমন কোথাও ব্যথা করছে কিংবা খিদে পেয়েছে অথবা ডায়াপার নোংরা হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ বাচ্চার সমস্যা দূর করা বাঞ্ছনীয়।
বাচ্চার কান্না সামলানোর উপায়
O বাচ্চার ডায়াপার সম্পূর্ণ ভিজে গেলে বাচ্চা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বাচ্চার ঘুমও এর ফলে ভেঙে যায়। বাচ্চা নিজের অস্বস্তি বোঝাতে কাঁদতে শুরু করে। সুতরাং মাঝে মাঝেই বাচ্চার ডায়াপার বদলে দিলেই সে শান্ত হয়ে যাবে
O অনেক সময় ডায়াপার অনেকক্ষণ ভিজে থাকার ফলে ত্বকে র্যাশেজ হয়। এর কারণে জ্বালা, চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সুতরাং ডায়াপার বদলাবার সময় সেটা খেয়াল রাখা একান্ত দরকার। বাচ্চার ওই অংশের ত্বক সব সময় পরিষ্কার রাখা একান্ত দরকার। এছাড়াও প্রতিবার ডায়াপার বদলাবার সময় জিংক অক্সাইড-যুক্ত ন্যাপি ক্রিম বাচ্চার ওই অংশের ত্বকে অবশ্যই লাগান
O ৬ থেকে ৮ মাস বয়সি বাচ্চার নতুন দাঁত বেরোবার সময়। এই সময়টাও বাচ্চাকে সমস্যায় ফেলতে পারে
O অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও মায়ের কোলের আরাম চায়। এই ক্ষেত্রে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করলে এবং ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও বাচ্চা আরাম পায় এবং চুপ করে যায়।
বাচ্চা যদি রাত জাগে
জন্মের পর পরই বেশিরভাগ শিশু দিনে ঘুমায় এবং রাতে জেগে থাকে৷ কোনও কোনও সময় দিনে না ঘুমিয়ে বাচ্চা রাতেও ঘুমোতে চায় না। সুতরাং বাচ্চার সঙ্গে মা-বাবাকেও রাত জাগতে হয়। মা-বাবা বাচ্চাকে নিয়ে সমস্যায় পড়েন। বাচ্চার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়, যার ফলে সে ঠিকমতো ঘুমোতে পারে না। বাচ্চার যদি খিদে পায় অথবা অন্য কিছুর প্রয়োজন থাকে, তাহলেও বাচ্চা ঘুমাতে পারে না।
রাতে বেশ কয়েবার উঠে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার দরকার পড়ে। কারণ বাচ্চা একবারে বেশি পরিমাণে দুধ খেতে পারে না। ব্রেস্টপাম্পের সাহায্যে মাতৃদুগ্ধ স্টোর করে রাখতে পারেন এবং রাতে প্রয়োজনে সেটাই বাচ্চাকে খাওয়াতে পারেন। এতে মায়েরও আরাম হবে এবং বাচ্চাও ক্ষুধার্ত থাকবে না। এছাড়া এই বিষয়গুলির খেয়াল রাখা জরুরি—
O কোনও বিশেষ খেলনা বা চাদর নিয়ে শোওয়ার অভ্যাস যদি বাচ্চার থাকে, তাহলে যতক্ষণ না সে সেটা কাছে পাচ্ছে, ততক্ষণ বাচ্চা
O কিছুতেই ঘুমোতে চাইবে না। সুতরাং মা-কে তা খেয়াল রাখতে হবে।
O একটা সময় নির্দিষ্ট করে, সেই সময়টাতেই বাচ্চাকে রোজ ঘুম পাড়ান। ইচ্ছেমতো সময় বদলাবেন না
O জ্বর, সর্দি-কাশি, পেট ব্যথা, কানে ব্যথার কারণেও বাচ্চা অনেকসময় ঘুমোতে পারে না। এগুলোও মা-কেই দেখে নিতে হবে।
বাচ্চার ঘামাচি হলে
O অনেক সময় বাচ্চাদের ঘামাচির সমস্যা হয়ে থাকে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করলে ঘামাচি রোধ করা সম্ভব।
O বাচ্চাকে ঢিলেঢালা এবং মোলায়েম সুতির পোশাক পরান। ত্বকে ফুটবে এমন কোনও পোশাক বাচ্চার জন্য বাছবেন না
O বাচ্চার জন্য সবধরনের ট্যালকম পাউডার উপযুক্ত নয়। শুধু রাইস স্টার্চ-যুক্ত পাউডারই লাগাবেন, যাতে বাচ্চাকে ফুসকুড়ি এবং র্যাশেজ থেকে বাঁচানো যায়
O যেখানে ঘামাচি হয়েছে, সেখানে সারাদিনে ২ থেকে ৩ বার পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে দিন বা স্পঞ্জ করে দিন
O বাচ্চার জন্য অত্যন্ত সুগন্ধি সাবান বা তেল ব্যবহার করবেন না। কারণ, এতে কেমিক্যাল থাকতে পারে এবং বাচ্চার স্পর্শকাতর ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।
বাচ্চার মাসাজ
O মা নিজের উপর বিশ্বাস রেখে নিজেই শিশুর মালিশ করতে পারেন যদি সঠিক পদ্ধতি মেনে চলেন।
O বাচ্চার পা থেকে মালিশ শুরু করুন। হাতে তেল নিয়ে থাই থেকে মালিশ করা শুরু করে ক্রমশ নীচের দিকে নামুন
O বাচ্চার হাঁটু, গোড়ালি সর্বত্র মালিশ করুন। পায়ে আঙুল চক্রাকারে ঘোরান
O বাচ্চার হাত-বুক-পিঠ মালিশ করুন
O মালিশ করতে করতে বাচ্চা যদি কাঁদে, তাহলে কোলে নিয়ে বাচ্চাকে চুপ করান। দুধ খাওয়ার পর বা বাচ্চার শোওয়ার সময় মালিশ করবেন না।
বাচ্চার খেলনা
শিশুর জন্মের পর শুধু তার মা-বাবাই নয়, সকলেই বাচ্চার জন্য খেলনা কিনে থাকেন। বাচ্চার ঘর ভরে যায় খেলনায় ঠিকই, কিন্তু এর মধ্যে সব খেলনাই ভালো কোয়ালিটির হয় না। এই ক্ষেত্রে মা-কে জানতে হবে, কোন খেলনা শিশুকে দেওয়া যেতে পারে।
O বাচ্চার খাটের সঙ্গে লাগানো যায় সেরকম ঝুলন্ত রঙিন ছোটো ছোটো হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভল্লুক ইত্যাদি বাচ্চাদের জন্য খুব ভালো। এটা দেখে বাচ্চা আনন্দ পায় এবং চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে বাচ্চার কনসেনট্রেশনও বাড়ে
O অনেক খেলনায় ঘণ্টা লাগানো থাকে। প্লাস্টিকের একটা রিং-এর মধ্যে ঘণ্টাগুলো থাকে। খেলনাটা খুব নরমও হয়। হাওয়ায় যখন ঘণ্টাগুলো নড়ে, তখন তার থেকে মিষ্টি টুংটাং আওয়াজ বেরোতে থাকে, যেটা শুনতে শুনতে বাচ্চা কান্না ভুলে চুপ হয়ে যায়
O বাচ্চাদের হাতে খেলনা দেওয়ার আগে বড়োদের উচিত নিজেদের সেটা একবার পরীক্ষা করে নেওয়া। সঠিক মনে হলে তবেই বাচ্চার হাতে দেবেন
O বয়স অনুপাতে বাচ্চাদের খেলনাও নানারকমের হয়ে থাকে। তবে খেয়াল রাখা দরকার, বাচ্চার খেলনা যেন নরম হয় এবং কোনওরকম শার্প কোণ যেন না থাকে। কাপড়ের তৈরি খেলনা বা ভালো কোয়ালিটির রাবার অথবা প্লাস্টিকের তৈরি খেলনাই বাচ্চাকে দেওয়া উচিত। যেটা বাচ্চা মুখে দিলেও তার কোনওরকম ক্ষতি হবে না।
বাচ্চার খাবার
৩-৪ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের মুখ থেকে লালা পড়ে। বিশেষ করে দুধ খাওয়াবার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে দুধ ওগরাতে থাকে।
O দুধ খাওয়াবার পরে পরেই বাচ্চার সঙ্গে খেলা করা উচিত নয় কিংবা বাচ্চাকে বেশি নাড়ানো ঝাঁকানো উচিত নয়। দুধ খাওয়াবার পর বাচ্চাকে কাঁধে রেখে ধীরে ধীরে পিঠ চাপড়ানো দরকার, যাতে বাচ্চার তাড়াতাড়ি ঢেকুর ওঠে এবং এতে দুধ হজম হতেও সুবিধা হয়
O অনেক সময় ঠান্ডা দুধ খাওয়ালেও বাচ্চা মুখ থেকে দুধ তোলে, কারণ বাচ্চার ঠান্ডা দুধ খেতে ভালো লাগে না।