মণিমালা এখনও মা হয়নি। তাই ভাই অনুরোধ করতেই চলে এল মা-বাবাকে খুশিতে রাখার জন্য।
দিদি আসার পর বাবা-মাকে অনেকটা চিন্তামুক্ত দেখে, মনোজও বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল। কিন্তু এক সন্ধ্যায় সূচনা হল এক রহস্যজনক অধ্যায়ের।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মণিমালা তখন বাড়িতে থাকলেও, মনোজ ছিল না। ছেলেমেয়ের সামনে দিনেরবেলা মা- বাবাকে কখনও দরজা বন্ধ করে থাকতে দেখেনি মণিমালা। তার কাছে বিষয়টি আরও বিস্ময়ের এবং ভয়ের মনে হল, যখন সে ডাকাডাকি করেও দরজা খোলাতে পারল না। অগত্যা মণিমালা ভাই মনোজকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলল সব জানিয়ে।
অফিস ছুটি থাকার কারণে পাড়ার মোড়ে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল মনোজ। দিদির ফোন পেয়ে সে দ্রুত ফিরে আসে বাড়িতে।
ছেলে এসে দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। মা খুললেন দরজা। তাঁকে বেশ গম্ভীর দেখতে লাগছিল।
—কী হয়েছে তোমাদের? শরীর খারাপ? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মনোজ।
—না, তেমন কিছু হয়নি। একটা বিষয় নিয়ে আমরা একান্তে কিছু আলোচনা করছিলাম। ভিতরে আয়। উনি তোদের ভাইবোন-কে কিছু বলতে চান আজ।
ভয় এবং বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটানোর পর ভাইবোন দু’জনে ঘরে ঢুকল মায়ের সঙ্গে।
—কী হয়েছে বাবা? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল মনোজ।
ওদের ভাইবোনকে ইশারায় বসতে বললেন সরোজ। তারপর কয়েক সেকেন্ড বাদে ঘরের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মুখ খুললেন তিনি। প্রশ্নের সুরে বললেন, “আচ্ছা, তোরা বল তো, বিয়ের মতো শুভ কাজে বাইরের একটা উটকো লোকের রীতিনীতি পালনের অধিকার আছে? মানে, যে-কেউ কি বাবার ভূমিকা নিতে পারে?”
এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে ভাইবোন প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে— মানে!
—হ্যাঁ, মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে গেছি, তাই আজ বলতে দ্বিধা নেই। আমি আসলে তোদের বাবা নই, সম্পর্কে মামা! তাও আবার নিজের রক্তের সম্পর্কের মামা নই, প্রতিবেশী পাতানো মামা।
এই পর্যন্ত বলে সরোজ থামলেন এবং মনোজ ও মণিমালার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। গীতা তখন মাথা নিচু করে খাটের উপর বসে রয়েছেন।
কিছুটা থমকে থাকার পর, মায়ের দিকে তাকিয়ে মনোজ জিজ্ঞেস করল, ‘মা, বাবা ভুল বকছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?’
মনোজের প্রশ্নের উত্তরে সরোজ আবারও শান্ত গলায় জানালেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি মনোজ। আজ তোমাদের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে। নয়তো আমি হয়তো সত্যিই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলব।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মণিমালার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল— ‘কী সত্যি…!’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সরোজ। তারপর ডুব দিলেন স্মৃতির গভীরে। বলতে শুরু করলেন, ‘তোদের মা এবং আমি হিমাচলের একটি গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। বলতে গেলে একই পরিবারের মতো। ছোটোবেলা থেকেই আমরা ভাইবোনের মতো ছিলাম। তোদের মা আমাকে ফোঁটা দিত, রাখি পরাত। আমরা একই স্কুলে, একই ক্লাস-এ পড়তাম। বড়ো হয়ে দু’জনে হায়ার এডুকেশনের জন্য আহমেদাবাদ, মানে এখানে এলাম। আমি যে মেসবাড়িতে থাকতাম, তার থেকে খানিক দূরে লেডিজ হস্টেল-এ থাকত তোদের মা। দেখা হতো নিয়মিত। ভাইবোনের বেশ আড্ডাও হতো।’
‘একদিন আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিল সুনির্মল। আমি আর সুনির্মল একই মেস-এ থাকতাম। কিন্তু সুনির্মল চাকরি করত একটি প্রাইভেট সংস্থায়। আমিই সুনির্মলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম তোদের মা-কে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তারপর কবে, কীভাবে ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল, সম্পর্ক গভীর হয়েছিল, তা আমি জানতাম না। ‘হঠাৎ একদিন তোদের মা কাঁদতে কাঁদতে এসে দেখা করল আমার সঙ্গে। এত হাসিখুশি বোনটাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিছুতেই ও বলতে পারছিল না ওর দুঃখ-কষ্ট কিংবা সমস্যার কথাটা। তারপর সব জানলাম অনেক অনুরোধের পর। কিন্তু সুনির্মল যে মেস ছাড়ার আগে গীতার সর্বনাশ করে গেছে, তা জেনে মর্মাহত হলাম। কারণ, সুনির্মলের ব্যবহারে কোনও দিন অবিশ্বাসের চিহ্নও খুঁজে পাইনি। চাকরিসূত্রে অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছে বলে মেস ছেড়েছিল। সে। তখন কে জানত যে, আসলে ও পালিয়েছে!’
‘অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না সুনির্মলকে। উলটে পুলিশের মাধ্যমে অন্য এক মর্মান্তিক ঘটনার খবর পেয়েছিলাম। সুনির্মলের ওই অপকর্ম করে পালিয়ে বেড়ানোর খবর পেয়ে, বালিগঞ্জে বাপের বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করেছিল তার বিবাহিত স্ত্রী। আর তার বৃদ্ধা অসহায় মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিল একরত্তি মেয়েকে। মণি তুই তখন কথা বলতেও শিখিসনি।’
‘সব জেনে গীতা চমকে দেওয়ার মতো একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল। পুলিশের সাহায্য আর আইনি অনুমতি নিয়ে, কলকাতা থেকে মণিকে নিয়ে এসে নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়েছিল। অথচ নিজেই তখন অসহায়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গীতা-র ওই অদ্ভুত মানসিক শক্তি, মহানুভবতা আর সাহস দেখে আমি হতবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ঘোর কাটতেই আমার মনে হয়েছিল, একা একটা মেয়ের পক্ষে এত বড়ো লড়াই চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাই হাত বাড়িয়ে দিলাম সাহায্যের।’
‘আর হিমাচলে নিজেদের বাড়িতে ফেরা হল না আমাদের। সমাজের রক্তচক্ষু এড়াতে গিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম ‘স্বামী-স্ত্রী’র পরিচয়ে। কিন্তু সে তো শুধু সমাজের চোখে, আসলে তো আমরা দুটি ভাই-বোন। পবিত্র সে সম্পর্ক। আজও সে পবিত্রতা বজায় রেখে চলেছি দু’জনে এবং দায়িত্ব পালনেও সাফল্য বজায় রেখে চলেছি। তোরা দু’জনেই সুনির্মলের সন্তান হলেও, তোদের মা আলাদা। কিন্তু গীতা তোদের দু’জনকেই সমান স্নেহে মানুষ করেছে। আর আমি শুধু পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে গেছি মাত্র। কিন্তু এতদিন এই ‘স্বামী-স্ত্রীর’ অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আর লুকিয়ে তোদের মায়ের হাত থেকে রাখি পরতে পারব না। এবার তোদের সামনেই গীতার হাত থেকে ফোঁটা নিতে চাই, রাখি পরতে চাই। তোরা সে অনুমতি দিবি তো?’
এতক্ষণ সরোজের কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না ঘরে। কিন্তু সরোজের কথা শেষ হতেই কান্নার বাঁধ ভাঙল মণিমালার। গীতাকে আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদছে সে। গীতার চোখ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, সরোজের পা ধরে বসে পড়েছে মনোজ। সরোজের স্বার্থত্যাগের মহানুভবতার কাহিনি শুনে মনোজের তখন বাকরুদ্ধ অবস্থা।
একসময় ঘরে দেখা গেল এক স্বর্গীয় সুখময় দৃশ্য। সরোজ, গীতা, মণিমালা, মনোজ সবাই একে অন্যকে জাপটে ধরে রয়েছে। সবার চোখেই জল। দুঃখ, যন্ত্রণা আর গর্বভরা সেই অনুভূতি যে কেমন ছিল, তা ওরা চারজন ছাড়া অনুভব করা অন্যদের কাছে দুরূহ বিষয়।
যাইহোক, মনোজের মর্মান্তিক অতীত এবং গীতা ও সরোজের অকল্পনীয় মহানুভবতার কাহিনি শুনে পৃথা, ওর মা- বাবা, এমনকী দিদিমাও বিস্ময় প্রকাশ করেন ও মুগ্ধ হন। তারপর, মনোজের অনুরোধ মতো রীতিনীতি ছাড়াই বিয়ের অনুমতি দেন পৃথার দিদিমা। আর এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হন মনোজের ‘বাবা’ ওরফে পাতানো মামা। কারণ, তাঁকে আর অসহায় ভাবে ‘বাবা’ সাজতে হবে না।