‘কোটি থেকে এক কম !

হ্যাঁ, তাই ঊনকোটি।’

সামনের পাকদণ্ডীটা সতর্কতার সঙ্গে সামলে আমাদের ত্রিপুরা ভ্রমণের সারথি বললেন, ‘স্থানীয় ভাস্কর কালু কামার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক রাতের মধ্যে রঘুনন্দন পাহাড়ে কাশীধাম গড়বেন। কালু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাতারাতি এক কোটি দেবদেবীর মূর্তি খোদাই শুরু করেন। কাজ সেরে তিনি গুনে দেখলেন, কোটি থেকে একটি মূর্তি কম! ওদিকে, শর্তানুযায়ী ভোরের সূর্যালোক তাঁর শিল্পকর্মের উপরে এসে পড়ায় আর মূর্তি গড়া যাবে না। একটি মূর্তি কম হওয়ার কারণে পার্বতী তাঁর স্বামী মহাদেব সহ রঘুনন্দন পাহাড় পরিত্যাগ করেন…। এমনটাই ত্রিপুরা রাজপরিবারের ইতিহাস ‘রাজমালা’য় লেখা আছে।

আগরতলা থেকে ঊনকোটি যাচ্ছি। আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু পথে পাকদণ্ডী পড়ে অনেক। পথে প্রচুর মুকুলিত লিচু বাগান, বাঁশ ঝাড়, রবার চাষ, চা বাগান, রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ, পাখিদের ওড়াউড়ি, হাল্কা ঘন জঙ্গলপথে অনর্গল ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাক, ছোটো ছোটো নদী-ব্রিজ— এইসব দেখা-শোনার মধ্যে দিয়ে চলেছি। পথের দূরত্ব কমাতে পূর্ত দফতরের বিশাল কর্মকাণ্ড চলছে, তাই আমাদের ইনোভা-র গতি কমছে মাঝে মধ্যেই।

সারথি ফের শুরু করলেন— আর এক কিংবদন্তি কৈলাসধাম থেকে কাশীধামের পথে কোটিসংখ্যক দেব-দেবীদের নিয়ে চলেছেন ভোলামহেশ্বর। পথশ্রমে ক্লান্ত দেব-দেবীরা রাতের বিশ্রাম নিতে চাইলেন এই রঘুনন্দন পাহাড়ে। দেবাদিদেব সম্মত হলেন এই শর্তে যে, ব্রাহ্মমুহূর্তে, সূর্যোদয়ের আগেই যাত্রা শুরু হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে ব্রাহ্মমুহূর্তে দেব-দেবীদের ঘুম ভাঙল না। দেবাদিদেব একাই কাশীধামের পথে রওনা দিলেন। ওদিকে রঘুনন্দন পাহাড়ে ভোরের সূর্যালোক এসে পড়তেই শর্তভঙ্গের কারণে বাকি দেব- দেবীরা পাথরে রূপান্তরিত হলেন। এই ভাবেই এক কোটির এক কম, ঊনকোটি হয়ে এখানেই রয়ে গেলেন তাঁরা।

সারথির কথা শুনতে শুনতে গাড়ি থামল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক সংরক্ষিত ঊনকোটির প্রবেশ পথে। রেজিস্টারে নাম, ঠিকানা, পরিচিতি, মোবাইল নম্বর লিখে প্রবেশ করলাম। না, কোনও প্রবেশমূল্য নেই।

রেলিং ঘেরা বাঁধানো পথে এগোতেই সিঁড়ি। নামতে নামতেই সামনের পাহাড়ের গায়ে বিস্তৃত জটাজুটধারী দেবাদিদেবের প্রস্তরমূর্তি। বিশালাকার মূর্তিটির জটা-সমাবেশ, কর্ণকুণ্ডল, কণ্ঠহার, মস্তকের শিরোভূষণে জ্যামিতিক নক্সার সারল্য এবং পাহাড়ের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নতোন্নত ভাস্কর্যশিল্প অবাক হয়ে দেখতে হয়। এ ছাড়াও পুরো পাহাড়ের গায়ে শিবের মূর্তি ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান দেব-দেবী মূর্তির আশ্চর্য সব ভাস্কর্যশিল্প।

দেখতে দেখতে মনে পড়ছে দক্ষিণ ভারতে মহাবলীপুরমের রক-কাট ভাস্কর্যশিল্পের কথা। যদিও শৈলীর দিক থেকে তা ভিন্ন ধারার, তবুও কোথাও যেন একটা সাদৃশ্য! বেশ কিছু ভগ্ন-ভাস্কর্যও এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। অনেক মূর্তিতে ফাটল-রেখা, সম্ভবত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট। অসামান্য এই শিল্পকর্মগুলির সংরক্ষণে ভারপ্রাপ্ত দফতরের আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে, কালের গতিতে হয়তো হারিয়ে যাবে কোনও দিন৷

প্রচুর সিঁড়ি ভেঙে, ওঠা-নামা করে এসব দেখতে সময় লাগল বেশ কয়েক ঘণ্টা। জটাজুটধারী শিবের মূর্তিভাস্কর্যটি কালভৈরব বলে খ্যাত। পাশেই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে জলধারা, সৃষ্টি হয়েছে স্বল্প-পরিসর কুণ্ড। সেই কুণ্ডের জল ফের পাথরের খাঁজ বেয়ে নীচে, আরও নীচে সবুজ গাছ-গাছালির ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যেন এই জায়গাতেই তার প্রকাশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সমগ্র পাহাড়ের গায়ে তৈরি হয়েছে প্রচুর সিঁড়ি ধাপ। কর্তব্যরত প্রহরীরা পাহাড়জুড়ে নজরদারির কাজে ব্যস্ত।

গাছে গাছে ফুল, প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, পাখিদের কলতানে সবুজে ছাওয়া ঊনকোটির মনোরম পরিবেশ সিঁড়ি ভাঙার ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে। এমন অপূর্ব দর্শনীয় স্থলের আকর্ষণে দেশ-বিদেশের মানুষ এখানে ছুটে আসেন বছরের নানা সময়ে। এবার ফিরতে হবে। কাছেই কৈলাস শহরে রাজ্য পর্যটনের ঊনকোটি গেস্ট হাউসে দুপুরের আহারপর্ব সেরে আগরতলা ফিরতে রাত হয়ে গেল।

একটু ইতিহাস

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ছোটো হলেও পর্যটকদের কাছে কিছুটা কম আকর্ষণীয়। তার কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার খামতি। রেলপথে আগরতলা যেতে সময় এবং শারীরিক ধকল কম নয়। একমাত্র উপায়— আকাশপথ। মূলত ত্রিপুরী, রিয়াং, জামাতি, চাকমা, লুসাই, মগ প্রভৃতি নানান উপজাতিদের বসবাস দীর্ঘকাল ধরে। বাঙালিদের বসবাসও উল্লেখযোগ্য। সকলের মেলবন্ধনে ত্রিপুরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ।

মহাভারতেও ত্রিপুরার উল্লেখ মেলে— চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতির পুত্র দ্রুহ্য কিরাত দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরায় এসে রাজ্যপাট শুরু করেন। সেই বংশের চল্লিশতম বংশধর ত্রিপুর-এর নাম থেকেই ত্রিপুরা রাজ্যের নামকরণ।

‘রাজমালা’ গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী জানা যায়, ত্রিপুরায় প্রায় তেরোশো বছর ধরে রাজত্ব করেন গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দিন কর্তৃক উপাধিপ্রাপ্ত ‘মাণিক্য’ রাজবংশ। আধুনিক ত্রিপুরার গোড়াপত্তনের সময়কাল ধরা হয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের আমল থেকে। তাঁর রাজত্বকাল ত্রিপুরার ইতিহাসে উজ্জ্বলতম সময়। ইতিহাসের নানান উত্থান-পতন এবং ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা লাভ করে ত্রিপুরা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের যোগসূত্রের কথা আমরা প্রায় সকলেই অবগত। তাঁর লেখা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস এবং ‘বিসর্জন’ নাটকে ত্রিপুরা রাজপরিবারের কাহিনির প্রতিফলন দেখতে পাই।

রানওয়ে ছুঁয়েছে

আকাশপথে কলকাতা থেকে আগরতলা মহারাজ বীর বিক্রম বিমানবন্দর পৌঁছাতে সময় লাগল মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এর থেকে ঢের বেশি সময় লাগে বিমানবন্দরে প্রবেশ করার পর থেকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত আবশ্যিক প্রক্রিয়া এবং নিয়মকানুন পর্ব সমাধা হতে।

বিমান-যাত্রায় জানলার পাশের আসনটি মিললে উড়ান-কালে অনেক উঁচু থেকে দেখা যায় শহর গ্রাম, বাড়ি ঘর, নদী নালা, চাষজমি…. কিংবা হঠাৎ করে মেঘের রাজ্যে প্রবেশ-দৃশ্য। এসব দেখতে দেখতেই সামান্য ঝাঁকুনি! বিমান আগরতলার রানওয়ে ছুঁয়েছে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...