সফর শুরু হল দুর্গাবাড়ি চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে। তারপর স্মার্ট সিটি আগরতলার জগন্নাথ মন্দির, উমামাহেশ্বরী, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, বেণুবন বিহার, এমবিবি কলেজ, ‘পূর্বাশা’ বিপণি দেখে দুপুরের ভোজন-বিরতি। এর পর ‘হেরিটেজ পার্ক”। ভ্রমণের প্রথম দিন এই পার্কটি দেখলেই গোটা ত্রিপুরা রাজ্যের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয়স্থল, রেলপথ, রেলস্টেশন, টানেল, নদী-ব্রিজ, মন্দির, মসজিদ, বুদ্ধ মন্দির প্রভৃতির অসামান্য রেপ্লিকা-দর্শন হয়ে যাবে। হ্যাঁ, এই পার্কেই দেখা গেল আগরতলা নামকরণ সম্পর্কিত ‘আগর’ বৃক্ষ। সুসজ্জিত পার্কটি যেন সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের ঐতিহ্য বহন করছে।

উজ্জয়ন্ত প্যালেস

পড়ন্ত বিকেলে মায়াময় আলোয় উদ্ভাসিত ‘উজ্জয়ন্ত প্যালেস’-এর প্রবেশতোরণ দিয়ে প্রবেশ করতেই সুসজ্জিত বাগিচা সরণি মনে পড়িয়ে দেয় তাজমহলের বাগিচা সরণির কথা। সরণির শেষে স্বমহিমায় অবস্থান করছে ১৮৯৯ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে নির্মিত অভিনব স্থাপত্যশৈলীর রাজপ্রাসাদ। দু-পাশে রাধাসাগর এবং কৃষ্ণসাগর জলাশয় প্রাসাদের সৌন্দর্যবর্ধন করছে। মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য এই প্রাসাদ নির্মাণ করান বিখ্যাত ‘মার্টিন অ্যান্ড বার্ন’ কোম্পানিকে দিয়ে। তৎকালীন নির্মাণব্যয় দশ লক্ষ টাকা৷

এই প্রাসাদের আগে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্য-র আমলে পুরাতন আগরতলায় নির্মিত রাজপ্রাসাদ, সেটি ১২ জুন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার পর এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ।

বর্তমানে এখানে হয়েছে রাজ্য সংগ্রহশালা। ত্রিপুরা রাজ্য এবং তার আশপাশের জনজীবনের শিল্প-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মাণিক্য রাজবংশের ইতিহাস, ত্রিপুরাবাসীদের পোশাক-আশাক, জীবনযাপন, হস্তশিল্প, মুদ্রা প্রভৃতির সংগ্রহ, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, দেবদেবী মূর্তি— এইসব দেখতে লেগে গেল অনেকটা সময়। সন্ধ্যার পর আলোক- শোভিত রাজপ্রাসাদ, বাগিচা স্বপ্নময় হয়ে ওঠে।

সকাল পৌনে দশটায় বিমানবন্দরে নামার পর থেকে এতসব দেখতে ধকল কম হয়নি। রাজ্য পর্যটনের গীতাঞ্জলি অতিথিনিবাসে ফিরে নৈশাহার সেরে ঝিঁঝিঁপোকাদের ঐকতান শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে।

ত্রিপুরাসুন্দরী এবং…

সকাল সকাল চলেছি উদয়পুর। একান্ন পীঠের অন্যতম সতীপীঠ ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এই মন্দির মাতাবাড়ি নামেও পরিচিত। অনেকের মতে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী বা ত্রিপুরেশ্বরী থেকেই নাকি ত্রিপুরা। এই মন্দির ‘কূর্ম পীঠ’ নামেও পরিচিত। মন্দিরের ছাদটি চারচালা, কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশের আকৃতি। শিখর বৌদ্ধস্তূপাকৃতি। তার উপর শীর্ষ-কলস। সমস্ত মন্দিরগাত্রের রং উজ্জ্বল টেরাকোটা-বর্ণ। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ধন্যমাণিক্য বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন। প্রতি বছর দেওয়ালির সময় এখানে খুব বড়ো মেলা হয়।

মন্দির চত্বরে ভিড় কম। গর্ভগৃহে দেবী মূর্তি দুটি। একটি পাঁচ ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের কালী মূর্তি ‘ত্রিপুরেশ্বরী”। অপরটি দু-ফুট উচ্চতার ‘ছোটো-মা’, চণ্ডী মূর্তি। লাল ওড়না ঢাকা ত্রিপুরেশ্বরীর কেবলমাত্র মুখমণ্ডল দৃশ্যমান। ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রে কর্তিত সতীর ডান পায়ের অংশ এখানে পড়েছিল।

মন্দির পরিক্রমা সেরে, সিঁড়ি ভেঙে নেমে সামনেই বিশাল পুষ্করিণী ‘কল্যাণসাগর’। স্বচ্ছ জলে খেলা করছে প্রচুর মাছ। কচ্ছপের দেখাও মেলে। অনেকে মাছদের খাবার দিচ্ছেন।

সতীপীঠ থাকলে ভৈরব থাকবেন। কাছেই বিজয়সাগরের তীরে ত্রিপুরেশ্বরীর ভৈরব তথা শিব মন্দির। জগন্নাথ দিঘির পাড়ে জগন্নাথ মন্দির। তার পর গুণাবতী মন্দিরগুচ্ছ, রেলিং ঘেরা, তাই বাইরে থেকেই দেখে চলে এলাম গোমতী নদীর তীরে এক সময়ের ত্রিপুরার রাজধানী এবং রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে। সেখান থেকে সামান্য এগিয়ে দেখা গেল মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যর প্রতিষ্ঠিত ভুবনেশ্বরী মন্দির। বর্তমানে এএসআই সংরক্ষিত বেলেপাথরের ছিমছাম মন্দির এবং চত্বর। উঁচু ভিত্তি-চত্বরের উপর চতুষ্কোণাকৃতি (প্রথম অংশ ছোটো, দ্বিতীয় অর্থাৎ গর্ভগৃহ অংশটি বড়ো) কূর্মাকৃতি চালার উপর বৌদ্ধস্তূপাকৃতি শীর্ষদেশ।

এই সেই মন্দির, যার কথা পড়েছি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে এবং নাটক ‘বিসর্জন’-এ। মন্দির বিগ্রহহীন। রাজর্ষি-র কাহিনি অনুযায়ী পুরোহিত রঘুপতি কর্তৃক গোমতীর জলে বিগ্রহ বিসর্জিত!

কাছেই এক রেলিংঘেরা চত্বরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। ফেরার পথে চোখে পড়ল নড়বড়ে এক ওয়াচ টাওয়ার, সংস্কারের অভাবে সেটায় ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ। আর একটু এগোতেই খোলা জায়গাতে সংস্কারের অভাবে জাঁকিয়ে বসা গাছ-গাছালির আড়ালে ভগবান বিষ্ণুর ভগ্নমন্দির।

নীরমহল-এ চল্লিশ মিনিট

দৃশ্যপট বদলে গেল। জমজমাট মেলাঘর বাজার। চলছে বিকিকিনির ব্যস্ততা। তার মধ্যে দিয়ে ডানহাতি পথ ধরে আমাদের ইনোভা পৌঁছাল রুদ্রসাগরের তীরে। বিস্তীর্ণ জলাশয়ের দিগন্তে শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ দৃশ্যমান। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র জলমধ্যে প্রাসাদটি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে নির্মাণ করান। নীরমহল নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ন’বছর। দূর থেকে দেখলে মনে হয় প্রাসাদটি যেন জলে ভাসমান। প্রসঙ্গত ভারতে আর একটি জলমধ্যে প্রাসাদ আছে রাজস্থানের উদয়পুরে। জলমহল তথা লেক প্যালেস, (জগনিবাস প্রাসাদ)। বর্তমানে সেটি বিলাসবহুল হোটেলে পরিণত।

রুদ্রসাগরের জলে মোটরচালিত নৌকা দুপুরের শান্ত পরিবেশ ব্যাহত করে ভট ভট আওয়াজ তুলে এগোচ্ছে। জলাশয় ছেয়ে আছে শ্যাওলা এবং প্রচুর কোঁকড়ানো পদ্মপাতায়। ফুল নেই। এখন ফুলের সময়ও নয়। আকাশে পাখিদের ওড়াউড়ি, জলে হাঁসেদের দলবদ্ধ বিচরণ— এসব দেখতে দেখতেই নীরমহল স্পষ্ট হচ্ছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, প্রাসাদের ভিত্তি অংশ টেরাকোটা-বর্ণরঞ্জিত, বিভাজন-রেখায় আলাদা। উপরিভাগ শ্বেতশুভ্র। প্রাসাদের কাছে পৌঁছাতেই নৌকাচালকদের বার্তা— ‘সময়সীমা চল্লিশ মিনিট’।

তিরিশ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়ে প্রবেশ করলাম মাণিক্য রাজবংশের রাজকীয় বিলাস-ভাবনায় নির্মিত গ্রীষ্মকালীন আবাস নীরমহল-এর অন্দরে। চব্বিশটি কক্ষসম্বলিত প্রাসাদটি দু’টি অংশে বিভক্ত— অন্দরমহল এবং নাচ-গান-নাটক, সাংস্কৃতিক রাজকীয় অনুষ্ঠানের জন্য কক্ষ, মুক্তমঞ্চ, বাগিচার অপরূপ সমন্বয়। স্থাপত্যশৈলীর অভিনবত্বে নীরমহল সত্যিই অনন্য। তবে সমগ্র প্রাসাদ পায়ে হেঁটে দেখতে চল্লিশ মিনিট সময়সীমা যথেষ্ট নয়। কোথাও কোথাও প্রাক-বিবাহ ফটোশুট চলছে।

পা বাড়ালেই…

দুপুরের আহারপর্ব সেরে পৌঁছালাম বিশালগড় সাব-ডিভিশনের অন্তর্গত কসবায়, কসবেশ্বরী মাতার মন্দিরে। অনেকে কমলাসাগর কালী মন্দিরও বলেন। কালী মন্দির হলেও কসবেশ্বরী আসলে দুর্গা মূর্তি। বিশেষত্ব হল, দেবীর আসন- -ভূমিতলে দেবাদিদেব মহাদেবের অধিষ্ঠান। মন্দিরের নির্মাণ নক্সা কূর্মাকৃতি চালাঘরের আদলের উপর বৌদ্ধ স্তূপের মতো শিখরদেশ। মন্দিরগাত্রের বহির্ভাগ টেরাকোটা-বর্ণরঞ্জিত, অন্তর্ভাগ দুধ-সাদা। মহারাজা কল্যাণমাণিক্য এই মন্দির স্থাপনার কাজ শুরু করেন এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে মহারাজ ধন্যমাণিক্য সেই নির্মাণকার্য সমাপন করেন। ভক্তবৃন্দের কাছে দেবী কসবেশ্বরী অত্যন্ত জাগ্রত। মন্দিরের সামনের পথ ধরে কিছুটা এগোতেই বিশাল দিঘি— কমলাসাগর।

বিকেলের চা-পর্ব সারলাম রাজ্য পর্যটনের ‘কুমিল্লা ভিউ ট্যুরিস্ট লজ’-এ। চমৎকার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে লজের ছাদে উঠে দেখি চারদিকে সবুজে সবুজ গাছ-গাছালি, ধানক্ষেত, নীল আকাশের পটভূমিতে লাল পলাশের রংবাহার, অদূরে দেখা যাচ্ছে কাঁটাতারে ঘেরা সীমান্তের ও-পাশে বাংলাদেশ! পা বাড়ালেই… এমন নিকট অথচ দূর!

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...