পৃথা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১২টা বাজে। মিহির এখনও এসে পৌঁছোল না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল পৃথা। কিছুক্ষণ আগে পৃথা যখন মিহিরকে ফোন করেছিল, তখন উত্তর পেয়েছিল, ‘দিস নাম্বার ইজ নট রিচেবল’।

—এত দেরি তো করে না মিহির! আজ যে কী হল! কোনও দুর্ঘটনায় পড়েনি তো? নট রিচেবল কেন বলছে? চিন্তায় পড়ে যায় পৃথা।

শুধু খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথার। খুব ঘাবড়ে যায় সে। কারণ, এই শহরটা তার কাছে নতুন। সে প্রায় কাউকেই চেনে না। কার সাহায্য নেবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না। বাপের বাড়ির শহর কলকাতা হলে, সে এতক্ষণে দু’চারজনকে ডেকে নিয়ে সাহায্য চাইত।

আসলে, মিহিরের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর দিল্লি চলে আসে পৃথা। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে সেলস এগজিকিউটিভ হিসাবে কাজ করে মিহির। তা প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল মিহির এবং পৃথা দিল্লিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ওরা এখনও মা-বাবা হয়নি। বিয়ের পর ওরা এখনও গোল্ডেন টাইম পাস করছে। এবার হয়তো দুই থেকে তিনজন হওয়ার প্ল্যান করবে।

—অফিস কলিগ ছাড়াও মিহিরের অনেক বন্ধু আছে দিল্লিতে। তাদের সঙ্গে সন্ধেবেলা আড্ডাও মারে মিহির। কিন্তু দেরি হলে ফোন করে জানিয়ে দেয়। আজ যে কী হল… ভাবতে থাকে পৃথা।

—অনেক সময় অবশ্য অফিস-এ বস্-এর সঙ্গে মিটিং করতে গিয়েও দেরি হয়। আর দেরি হলেই এসে নানা অজুহাত দেবে। কখনও বলবে, ‘বস্ আমাকে একটা জরুরি কাজ করতে দিলেন অফিস ছুটির সময়।’ কোনও দিন হয়তো বলবে, ‘আজ বস্-এর সঙ্গে কফি শপ-এ গিয়ে কফি খেতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”

মিহিরের হার্ড ওয়ার্ক এবং অনেস্টির জন্য যে মিহিরকে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দেন ওর বস্, এটা জানে পৃথা। শুধু এটুকুই নয়, মিহিরের বস্-এর সম্পর্কে পৃথা জেনে গেছে আরও অনেক কিছু। মেয়েদের নিয়ে শপিং-এ যাওয়া, ককটেল পার্টিতে যাওয়া, এসবও যে বেশ পছন্দ করেন মিহিরের বস্, তা পৃথা জেনেছে মিহিরের মাধ্যমে। আসলে পৃথা এবং মিহির স্বামী-স্ত্রী হলেও বন্ধুর মতো। তাই মিহির মজা করে পৃথাকে অনেকবারই বলেছে, ‘পৃথা, তুমি তো একদিন শপিং-এ যেতে পারো আমার স্যার-এর সঙ্গে, তাহলে আমার ভালো প্রোমোশন হতো৷’ এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পেল পৃথা। ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজার আইহোল-এ চোখ রাখতেই পৃথা দেখতে পেল, মিহির এসে গেছে। এবার নিশ্চিন্ত হল সে এবং দরজা খুলে দাঁড়াল।

মোটরবাইক রেখে মিহির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পৃথা-র উদ্দেশ্যে বলল, “খুব কাজের চাপ ছিল, ফোন করতে পারিনি, সরি। খুব খিদে পেয়েছে, খাবার রেডি করো, ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

ডিনার-এর সময় মিহির পৃথাকে জানাল, ‘কাল আমাদের মুম্বই অফিস থেকে কয়েকজন স্টাফ আসবে। বস্-কে নিয়ে সবাই শপিং-এ যাবে। বাড়ির বউদের জন্য শাড়ি কিনবে সবাই। আমরা কেউ শাড়ি চিনি না। প্লিজ, তুমি একটু আমাদের সঙ্গে যাবে শপিং-এ?’

মিহিরের কথা শুনে পৃথা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এতগুলো পুরুষ মানুষের সঙ্গে একা যেতে ওর মন চাইছে না। আবার ভাবল যে, মিহির অবশ্য সঙ্গে থাকবে। তাই, কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে ‘হ্যাঁ” বলে দিল পৃথা৷

পরের দিন বিকেল পাঁচটার সময় ফোন এল মিহিরের। ‘পৃথা তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। ঠিক তিরিশ মিনিট বাদে আমরা তোমাকে গাড়িতে তুলব।’

পৃথা রেডি হয়ে ব্যাগটা নেবে, এমন সময় ডোরবেল বাজল।

দরজা খুলল পৃথা।

‘আসুন স্যার ভিতরে’– বলেই মিহির ওর বস্-কে ড্রইং-রুম-এ এনে বসাল।

পৃথা একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। মিহির ওর দিকে ঘুরে বলল, ‘কাম হিয়ার পৃথা, আলাপ করিয়ে দিই— আমার বস্ মিস্টার চ্যাটার্জী। আর স্যার, ও পৃথা, আমার স্ত্রী।’

পৃথা এবং মিস্টার চ্যাটার্জী দু’জনেই নমস্কার বিনিময় করলেন। হঠাৎ পৃথা-র কেমন যেন চেনা মনে হল ভদ্রলোককে। মিস্টার চ্যাটার্জীও পৃথাকে দেখে কেমন যেন চমকে গেলেন। তাঁর যেন খুব চেনা মনে হল পৃথাকে। এভাবেই কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর মিস্টার চ্যাটার্জীই পৃথাকে প্রশ্ন করলেন, “আরে তুমি সেই পৃথা না…? হাসপাতালে আলাপ হয়েছিল। মনে আছে, তোমার বাবা আর আমার বাবা একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন? হাসপাতালের ওয়েটিং রুম-এ আলাপ হয়েছিল আমাদের। একইদিনে আমাদের দু’জনেরই বাবা মারা গিয়েছিলেন!”

পৃথা-র সব মনে পড়ে যায়। কিন্তু সেও তো প্রায় দশ বছর আগের কথা। পৃথা এবার মিস্টার চ্যাটার্জীর উদ্দেশ্যে বলে, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি তো অভিজিৎ…?’

—এগজ্যাক্টলি। তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো দেখছি, এখনও আমার নামটা মনে রেখেছ?

পৃথা এবং মিস্টার চ্যাটার্জী পরস্পরের চেনা দেখে বেশ খুশি হল মিহির। এবার সে সত্যিই ভাবতে শুরু করল, বস্ তার প্রতি এবার আরও সদয় হবেন এবং ওর প্রোমোশনও হবে।

আরও দু’-চারটে বাক্য বিনিময়ের পর, ওরা তিনজনে গাড়িতে উঠল। ড্রাইভিং সিটে ছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জী। তাঁর পাশে বসেছিল মিহির এবং পৃথা বসেছিল পিছনের সিটে। তারা তিনজনই তিনরকম ভাবনায় ডুবেছিল। মিহির ভাবছিল, পৃথা এবং তার বস্-এর মধ্যে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক ঠিক কতটা এগিয়েছিল? আর পৃথা ভাবছিল সেই ফেলে আসা দিনগুলির কথা।

অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যখন আলাপ হয়েছিল, তখন পৃথা সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি, ভালো ছবি আঁকত সে। একটা বড়ো আঁকার স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল। ওখানে আবার দেখা হয়ে গিয়েছিল অভিজিতের সঙ্গে। অভিজিৎ যেমন ভালো ছবি আঁকত, তেমনই ভদ্র এবং বিনয়ী ছিল। তাই, অভিজিতের প্রতি একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল পৃথার, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেনি। হয়তো অভিজিৎও পছন্দ করত পৃথাকে, কিন্তু সেও মুখ ফুটে কখনও বলতে পারেনি। তাই আজ দশ বছর পর আবার দেখা হয়ে যেতেই পৃথা একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবার পরক্ষণেই ভাবতে থাকে, তার দুর্বল হওয়া উচিত নয়। কারণ, তার বিবাহিত জীবন সুখের। মিহির ভালো ছেলে। বন্ধুর মতো। তাই সে পুরোনো দিনের সব কথা মিহিরকে সময় মতো বলবে ঠিক করে।

আবার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় ভাবতে থাকেন, আঁকার স্কুলেও যে পৃথার সঙ্গে অনেকগুলি দিন পাশাপাশি কাটিয়েছে, তা তো মিহিরের সামনে বলা গেল না। যাইহোক, এর মধ্যে পৃথা আবার ভাবতে থাকে, মিহির তার বস্ অভিজিতের সম্পর্কে যেমনটা বলেছে অর্থাৎ, অভিজিৎ ভালো কিন্তু মহিলাদের সঙ্গে শপিং করতে ভালোবাসেন, ককটেল পার্টি-তে যান, এসব যেন মেলাতে পারছে না পৃথা। কারণ সে জানে অভিজিৎ অত্যন্ত নম্র ভদ্র একজন মানুষ, যে মেয়েদের চোখের দিকে সরাসরি তাকাতও না। গাড়িতে বসে এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পৃথা মৌনতা ভেঙে প্রশ্ন করে অভিজিতকে,

—ছবি আঁকা এখনও জারি আছে তো?

—ও তো আমার প্রাণ। একদিন মিহিরকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো, সব দেখতে পারবে। তবে আগের মতো রেগুলার আর আঁকা হয় না।

এসবের মধ্যে মিহির হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা তো শপিং মল পিছনে ফেলে এসেছি।”

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...