ভুজুং ভাজুং দিয়ে বৃদ্ধ বাবার থেকে জমি জায়গা সব নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েও সুনীলের মনে শান্তি নেই। বোন যেভাবে ঘনঘন এসে বাবার কানে ফুসমন্ত্র দিতে শুরু করেছে, তাতে কোনও দিন না বাবা আগেকার দলিল বদলে মেয়েকেও অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেয়। তবে একটাই বাঁচোয়া, বাবার হাঁপের টান যেভাবে বাড়ছে, মনে হচ্ছে আর বেশিদিনের মেহমান নয়— এই শীতেই হয়তো একটা এসপার ওসপার হয়ে যাবে। ততদিন একটু ঠেকিয়ে রাখতে হবে বোনকে

শীত পড়তে শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কষ্টও বাড়ল সর্বেশ্বরের। সকাল সন্ধেয় তো হয়ই, গ্রন্থপাঠ করতে করতেও কাশতে থাকে নাগাড়ে। সঙ্গে আসে হাঁফের টান, একেক দিন রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয় না। কিন্তু তবু কারও কথা শুনবে না, দুপুরে চান করে ঠাকুর দিয়ে আর সন্ধ্যায় আহ্নিক করার পর গীতাপাঠ চাই-ই। মানা করলে বলে গোটা জীবন করে এসেছি, এখন হুট করে কী করে ছাড়ি বল তো? গীতায় একটু তুলসী দিয়ে দু’ছত্র না পড়লে আমি যে মহাপাতকের ভাগী হব। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, ডাক্তারের ওষুধেও তেমন কাজ হয় না। ক’দিন ধরে একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। সুনীল নিয়মরক্ষার্থে ওষুধ এনে দিলেও মনে মনে ঈশ্বরকে জানায়— তাড়াতাড়ি বাবাকে তুলে নাও ভগবান। তাহলে বাবাও বাঁচে আর আমিও বাঁচি।

দিনকয়েক পরে পাড়ার ঝন্টুর পিসিমা এল বিহারের গিরিডি থেকে বাপের বাড়িতে। বৃদ্ধের অবস্থা খারাপ শুনে দেখতে এল। কথায় কথায় বলল তার খুড়শ্বশুরের কথা। তারও হাঁপানির অসুখ ছিল। অবস্থা খারাপ হতে বাড়ির লোক তাকে বারাণসির মুক্তি ভবনে রেখে আসে। সেখানেই বারো দিনের মাথায় মারা যায়।

বাড়ি ছেড়ে কেন শেষ অবস্থায় বারাণসি নিয়ে গেল— জিজ্ঞেস করতে বলল, বারণসিতে দেহ রাখলে মোক্ষলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না। তাদের ওদিকে অনেকে নাকি ওখানে গিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। শুনে ধর্মপ্রাণ মুমূর্ষু সর্বেশ্বর ছেলের কাছে বায়না ধরল সেও বারাণসিতে গিয়ে দেহ রাখবে। স্ত্রী থাকলে তবুও একটা কথা ছিল। কিন্তু সেও তো বছর বারো আগে অকালে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে, এখন কার টানে ঘরে পড়ে থাকবে সে?

সুনীল দেখল এই সুযোগ, একবার বাবাকে বারাণসিতে সরিয়ে দিতে পারলে সব চিন্তা থেকে মুক্তি। তাই প্ৰথমে গেল মদন ডাক্তারের কাছে। জিজ্ঞেস করতে ডাক্তার বলল বৃদ্ধ আর কয়েকদিনের মেহমান, শরীরের যা অবস্থা আর যেভাবে শীত বাড়ছে তাতে তার আগেও যে কোনও দিন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। তারপর বউ-ছেলেমেয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুনীল বোনকে না জানিয়ে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বারাণসির পথে।

ঝন্টুর পিসির নির্দেশ মতো দু’জনে গিয়ে হাজির হল বারাণসির মুক্তি ভবনে। ম্যানেজার ভৈরবনাথ শুক্লার সঙ্গে কথা বলে বাবার থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল। তাকেও রয়ে যেতে হল শেষ ক’টাদিন বাবার দেখাশোনা করার জন্যে। ম্যানেজার কিন্তু জানিয়ে দিল চোদ্দ দিনের মধ্যে যদি মৃত্যু না হয় তাহলে বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসী সুনীল তাতেই রাজি হয়ে রয়ে গেল বাবার কাছে।

মুক্তি ভবনে টাকাকড়ি না লাগলেও খাওয়া থাকার অবস্থা তেমন ভালো নয়। ঘরগুলো জরাজীর্ণ, আসবাবপত্রের বালাই নেই, তক্তপোশের শক্ত বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা। নিজের একটু কষ্ট হলেও সুনীল মনে মনে খুশিই হল— এই ভাবে থাকলে বাবার যাওয়া ত্বরান্বিত হবে।

ধীরে ধীরে দিন দশেক কেটে গেল সুনীলদের। কিন্তু বাবার অবস্থা একই রকম আর মৃত্যুর কোনও লক্ষণ না দেখে সুনীল তো প্রমাদ গুণল। আর চারদিনের মধ্যে বাবার যদি কিছু না হয়, তাহলে তো বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তখন কী হবে? তার সব মেহনত বেকার তো হবেই, এত টাকা খরচ সব জলে যাবে। ভেবে ভেবে শেষে একটা উপায় বের করল। বিকেলবেলা ম্যানেজারের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল— বাড়িতে বড়ো বিপদ, মায়ের শরীর খুব খারাপ, আজই তাকে একটু বাড়ি যেতে হবে, দু’দিন পরে চলে আসবে আবার। এদিকে কোনও অসুবিধা হবে না। পাশের রুমের বিদ্যামাসি এই দুটো দিন বাবাকে দেখবে বলেছে। এই বলে সুনীল সন্ধ্যায় ট্রেনে উঠে বসল। বাবাকে বুঝিয়ে বলে এল— ঘরে খুব বিপদ, দু’দিন পরেই ফিরে চলে আসব।

পরদিন সুনীল বাড়িতে ঢুকল কাঁদতে কাঁদতে। সবাইকে বলল গতকাল সকালে বাবা দেহ রেখেছে। দাহকাজ মিটিয়ে এখানে এসেছে। তারপর দিন দশেক পরে যথারীতি বাবার শ্রাদ্ধশান্তিও করল ঘটা করে। সবাই সুনীলের খুব প্রশংসা করল বাবাকে শেষ সময়ে মোক্ষধাম বারাণসিতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বলল সর্বেশ্বর সত্যিই ভাগ্যবান, খোদ বিশ্বনাথের চরণে এমন মোক্ষলাভ ক’জনার ভাগ্যে জোটে?

এরপর কেটে গেছে প্রায় বছর খানেক। অজন্তা বাবার অবর্তমানে তেমন একটা আসে না বাপের বাড়ি। সুনীলও নিশ্চিন্তমনে নিজের সংসার গুছিয়ে বসেছে। বাবার বা বোনের নাম মুখেও আনে না।

একদিন সকালে সুনীল ঘুম থেকে উঠে মুখহাত ধুয়ে এসে দুয়ারে বসে সবে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েছে কী হঠাৎ কানে এল কারও ডাক— সুনীল কোথায় রে?

চেনা স্বর শুনে অবাক হল সুনীল। উঠে এসে বাইরে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল— উঠোনে দাঁড়িয়ে বাবা। চেহারা আগের মতো থাকলেও শরীরে বেশ তরতাজা ভাব। সুনীল হাঁ করে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে, অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘তুমি বেঁচে আছো?”

—হ্যাঁ বেঁচে আছি। তুই কী ভেবেছিলি ? মরে গেছি, তাই না?” সুনীলের মুখে কথা নেই।

সুনীলের বউ সুমতিও বেরিয়ে এসেছিল। অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘বাবা, তুমি বেঁচে আছো? তবে যে তোমার ছেলে…।’

—চুপ করো তো। আগে বাবাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে খেতে দাও, বলে তার মুখ বন্ধ করে বাবাকে নিয়ে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল সুনীল। বুকটা ধকধক করছিল। উঠোনে মুখ বাড়িয়ে দেখল পাড়ার কেউ দেখেছে কিনা। কাউকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্ত হল। সুমতি বাবাকে মাদুর পেতে বসতে দিচ্ছিল।

—চলো, আগে বাবার জন্যে খাবার ব্যবস্থা করো বলে তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে সাবধান করে দিয়ে বলল, বাবার শ্রাদ্ধশান্তির কথা একদম বলবে না। পরে বাবাকে সব বুঝিয়ে বলব।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...