সূর্যটা এখন পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে। শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে কার্জন পার্কের মেহগনি আর ইউক্যালিপটাস গাছের মাথায়। পড়ন্ত বিকেলের আভায় কোজাগরি যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। ঝিকমিক করছে তার কালো চোখের তারা দুটো। চোখ তো নয় যেন উটির স্বচ্ছ সরোবর। শঙ্খশুভ্রর হঠাৎ অজন্তার কথা মনে পড়ল। সে হয়তো তার জন্য প্যারাডাইস সিনেমার সামনে অপেক্ষা করে এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে। সে তাকে ফালতু ছেলে ভেবেছে কিনা কে জানে। কাল তার সামনে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে শঙ্খশুভ্র ভেবে পেল না।অজন্তার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার কোজাগরির দিকে চোখটা পড়তেই সে বলল, “আচ্ছা আমাকে তোমার কী প্রয়োজন বললে না তো?”

—সেটা বলব বলেই তো তোমাকে এখন এক জায়গায় নিয়ে যাব।

—কোথায়?

—গেলেই দেখতে পাবে। চলো, বাস দাঁড়িয়ে আছে।

—দাঁড়াও, আগে ফুচকার পয়সা মিটিয়ে দিই। শঙ্খশুভ্র ফুচকার পয়সা মিটিয়ে দিয়ে কোজাগরির নির্দেশে একটা মিনি বাসে উঠে পাশাপাশি বসল। এরই মধ্যে ব্যাকপকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল মাইকেল জ্যাকসনের গানের সুরে— ‘ট্রিজ আর আওয়ার লাংস। দ্য এয়ার ইজ আওয়ার ব্রিদ’। শঙ্খশুভ্র মোবাইলটা হাতে নিয়ে নম্বরটা দেখেই বুঝতে পারল অজন্তার ফোন। সে সুইচ অন করে সাফাই গাইল, ‘হ্যালো অজন্তা একটা বিশেষ কাজে আটকে গেছি। কাল দেখা হলে সব বলব। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।”

অজন্তা লাইন কেটে দিল কোনও কথা না বলে। বোঝা গেল সে রেগে আছে। কথা ছিল ওরা আজ একসঙ্গে সিনেমা দেখবে। রেস্তোরাঁয় চাউমিন খাবে। মানুষ পরিস্থিতির দাস। কখন কোন পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। শঙ্খশুভ্র কি ভাবতে পেরেছিল অজানা অচেনা একটা মেয়ের সঙ্গে তাকে এখন কাটাতে হবে। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। একটু পরে কোজাগরি তাকে কনুইয়ের ধাক্কা মেরে বলল, ‘এই নেমে এসো।’

শঙ্খশুভ্র বাস থেকে নেমে কনডাক্টরকে দুটো টিকিটের টাকা দিল। আর ঠিক তখনই বাসটা হাড় বজ্জাতের মতো তার চোখের সামনে এক রাশ কালো পেট্রোলের ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল। শঙ্খশুভ্র নাকে রুমাল চেপে ধরল। পেট্রলের গন্ধ সে সহ্য করতে পারে না। বাসটা অনেকটা দূর চলে যেতেই শঙ্খশুভ্র নাক থেকে রুমালটা সরিয়ে দেখল কোজাগরি রাসমণি বাজারের রাস্তার ওপারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শঙ্খশুভ্র রাস্তা  পার হতেই কোজাগরি হাতের ইশারায় ওকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল৷ মনে হয় কোজাগরি ইচ্ছা করেই শঙ্খশুভ্রর সঙ্গে এখানে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। সন্ধে হতেই রাস্তার বিজলিবাতিগুলো জ্বলে উঠল, কিন্তু আলোগুলোর দেহে যেন প্রাণ নেই। কেমন নিষ্প্রভ। আবছা আলোয় দেখা গেল রাস্তার দুপাশে ভূতের মতো মানুষগুলো কাঁচা সবজি বিক্রি করছে। অফিস ফেরতা বাবুদের বেজায় ভিড় লেগে গেছে এরই মধ্যে।

এক জায়গায় কিছু মানুষের জটলা দেখে শঙ্খশুভ্র দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিড় ঠেলে ভিতরে যায় কার সাধ্যি। শঙ্খশুভ্র শুনতে পেল কে যেন আর্তস্বরে প্রাণভয়ে চিৎকার করছে – ‘কে আছো বাঁচাও। আমায় মেরে ফেলল।’

—চুপ শালা, ভেবেছিস হিস্সা না দিয়ে পালাবি। আজ তোর কোন বাপ বাঁচায় দেখি। অন্য আর একজনের ক্রুদ্ধ স্পর্ধিত কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল৷

শঙ্খশুভ্র অতি কষ্টে ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখল আধবুড়ো কঙ্কালসার মানুষের বুকের উপর পা তুলে দিয়েছে একটি যুবক। মাটিতে থাকা লোকটিকে দেখে বোঝা গেল তার উপর যথেষ্ট কিল চড় লাথি ঘুষি পড়েছে। একজন অসহায় লোককে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারা হচ্ছে অথচ প্রতিবাদ করার কেউ নেই। সকলেই মুখে কুলুপ এঁটে আছে। প্রতিবাদ করার সাহস কারওর নেই। শঙ্খশুভ্র ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা কী হয়েছে বলতে পারেন?’

একজন সাহস করে বলল, ‘আর বলেন কেন বাবু। ওই ছেলেটি এখানকার উঠতি মস্তান।আমরা এখানে কাঁচাআনাজ বেচতে আসি। আমাদের বিক্রি হোক না হোক এই মস্তানকে রোজ একশো টাকা দিতে হবে। না দিলে বাজারে বসতে দেয় না। ওই ইদ্রিস চাচা তিনদিন টাকা দেয়নি বলে ওকে মারছে।’

শঙ্খশুভ্র বলল, “আপনারা থানায় জানিয়েছেন?”

আর একজন এগিয়ে এসে বলল, “জানিয়েছি। কোনও ফল হয়নি। আমাদের কথা কে শোনে বলুন।”

শঙ্খশুভ্র বুঝতে পারল, যে রক্ষক সেই ভক্ষক। মস্তান ছেলেটি সবজি বিক্রেতা ইদ্রিস চাচার চুলের মুঠি ধরে সপাটে চড় মারতেই সে ককিয়ে উঠল, “তোমার পায়ে পড়ি আমাকে মেরো না। আমি কালই তোমার টাকা মিটিয়ে দেব।”

দৃশ্যটা দেখে শঙ্খশুভ্রর রক্তে আগুন ধরে গেল। তার ভিতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে বলে উঠল, ‘ওকে ছেড়ে দিন। আমি ওর টাকা মিটিয়ে দিচ্ছি। বলুন কত দিতে হবে’। মস্তান যুবকটি লাল চোখে শঙ্খশুভ্রকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, “মাত্র তিনশো টাকা।’

শঙ্খশুভ্র টাকা মিটিয়ে দিতেই মস্তান যুবকটি চলে গেল। আশপাশের সমস্ত মানুষগুলো শঙ্খশুভ্রর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। যেন তারা সাক্ষাৎ শ্রীহরি দর্শন করছে। যে লোকটি মার খেয়ে মাটিতে পড়েছিল সে ঠোঁটের কষের রক্ত হাতের চেটোয় মুছে হামাগুড়ি দিয়ে এসে শঙ্খশুভ্রর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। আধা হিন্দি আধা উর্দু ভাষায় কী যেন বলল, বোঝা গেল না। লাথ খাওয়া অসহায় মানুষটিকে দেখে শঙ্খশুভ্রর চোখদুটো ছলছল করে উঠল।

কোজাগরি ভিড় ঠেলে সামনে এসে ওর হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলে এসো।’

পচাখালের কাছে আসতেই দূর থেকে কারা যেন শিস দিয়ে উঠল। জায়গাটা অন্ধকার। যেন নরকগুলজার। খালের দু-পাশের বস্তিতে আলো জ্বলছে। কিন্তু রাস্তায় আলো নেই। কাঠের পুল পার হয়ে আসতেই দেখা গেল কাছের চায়ের দোকানে কিছু ছোকরা গুলতানি করছে। ঝুলন্ত এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় তাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু আবছা আলোয় ছায়ামূর্তিগুলোর মুখের বিড়ির আগুন জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে। কে যেন বলে উঠল, ‘গুরু তোমার ঐশ্বর্য রাই আসছে।’

–এই চুপ, সঙ্গে চিড়িয়া আছে। আর একজন প্রেতের কণ্ঠস্বর ভেসে এল কানে। হঠাৎ কোজাগরি একটা সিগারেটের দোকানের সামনে এসে শঙ্খশুভ্রর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘এই পাঁচশো টাকা দাও তো।’

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...