নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আজও অব্যাহত। স্বার্থান্বেষীরা চায় নারীরা মানসিক ভাবে দুর্বল থাকুক। আর এই কারণেই তারা বিশ্বাস করে এবং বোঝাতে চায় যে, মহিলারা ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করলেই সংসারে সুখশান্তি আসবে, পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা বজায় থাকবে, মেয়েরা ভালো বর পাবে এবং রোগীরা রোগমুক্ত হবে।

স্বার্থান্বেষীরা এও মনে করে, যে-কোনও কাজ করতে নাকি পুরুষরা কম সময় ব্যয় করে, নারীরা বেশি সময় ব্যয় করে। এই মানসিকতা কি সমর্থনযোগ্য? এটা কি কর্মরত নারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নয়? অথচ যাদের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র, সেই নারীরা কি আদৌ বুঝতে পারেন যে, এটা একটা বৈষম্য তৈরির বিশেষ কৌশল। স্বার্থান্বেষীরা আরও মনে করেন যে, নারীদের জন্য বাইরের জগত নয়, তাদের উচিত সংসারধর্ম পালন করা এবং পুজোপাঠে ব্যস্ত থাকা।

অবশ্য আজকের যুগের কিছুসংখ্যক নারী অনেক বেশি আধুনিকমনস্ক। তারা সংসার সামলিয়েও চাকরি করছেন দক্ষতার সঙ্গে। গৃহপরিচারিকা এবং বেবি সিটারদের সহায়তায়, বাড়ি এবং বাইরের কাজ উভয়ই ভালোভাবে পরিচালনা করেন তারা। চাকরি এবং সেইসঙ্গে সংসার ও সন্তানের যত্ন নেওয়া সহজ কাজ নয়, তবুও মহিলারা এটি ভালোভাবেই করে দেখিয়েছেন। মহিলাদের উচিত তাদের সঙ্গীকে বলা যে, সন্তান উভয়েরই, তাই দায়িত্বও উভয়ের।

ভারতের অনেক রাজ্য ও শহরে এমন অনেক মহিলা রয়েছেন, যারা খাবারের স্টল দিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন। তারা কেবল তাদের নিজের ব্যয়ভার বহন করেন না, বরং সংসারের আর্থিক চাহিদাও পূরণ করেন।

আমরা আমাদের চারপাশে এমন অনেক মহিলাকেই দেখি, যারা লেবুরজল, জুস, লস্যি এবং চা ইত্যাদির স্টল চালাচ্ছেন। এই নারীরাই আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। আসলে এরা সবাই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কারণ, বিয়ের পরেও এরা আর্থিক ভাবে সাবলম্বী। অনেকে বাড়িতে বসেও আয় করেন নানারকম কাজ করে। যেমন গল্প-কবিতা লেখা, অনুবাদ, প্রুফ রিডিং, এডিটিং, টাইপিং ইত্যাদি। তবুও তারা কেন পান না তাদের কৃতিত্বের সঠিক স্বীকৃতি ?

আসলে, সমাজে স্বার্থান্বেষীরা নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ রেখা টেনে রাখলেও, আধুনিকমনস্ক নারীরা সেইসবের তোয়াক্কা করেন না এবং এটাই হওয়া উচিত। নারীর কর্মমুখী, দৃঢ়চেতা স্বভাব-ই হয়তো স্বার্থান্বেষী শয়তানদের জন্য যোগ্য জবাব। আগামী দিনে নারীরা আরও যত বিচক্ষণ হবেন, আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হবেন, স্বার্থান্বেষীদের মুখোশ ততটাই খুলে যাবে। তারা ভবিষ্যতে কোণঠাসা হয়ে যাবে। তাই এখন সর্বস্তরের মহিলাদের উচিত, কর্মকে প্রাধান্য দেওয়া। কারণ, কর্মরত নারীরা যেমন আর্থিকভাবে সক্ষম, তেমনই চাকুরিজীবী হওয়ার অনেক উপকারিতাও রয়েছে। এর ফলে মহিলারা আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কারণ, তারা সমাজের অন্ধবিশ্বাস থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেন। তাই তাদের চেহারায় এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। কর্মরত মহিলারা আনন্দে থাকেন এবং একই সঙ্গে জীবনকে নতুন ভাবে দেখার সুযোগ পান।

এছাড়া, অর্থনৈতিক ভাবে সক্ষম কর্মজীবী নারীরা নিজস্ব আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা খুশি তাই কিনতেও পারেন। এর জন্য তাদের স্বামীর উপর নির্ভর করতেও হয় না। বিয়ের পর নারীরা চাকরি না করলে, ছোটোখাটো প্রয়োজনেও স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, তার কাছে হাত পাততে হয়। এই বিষয়টি চরম অস্বস্তিকর। এই অস্বস্তি থেকে নিজেকে বের করে আনতে, বিয়ের পরও প্রত্যেক নারীর আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। তবেই সমাজ তাদের আলাদা মর্যাদা দিতে বাধ্য থাকবে।

মেয়েদের মাথায় রাখতে হবে, সমাজের ধান্দাবাজরা মহিলাদের জন্য অনেক নিয়মের বেড়াজাল তৈরি করে রেখেছেন। এর মধ্যে একটি হল— পোশাক। মেয়েরা একটু খোলামেলা পোশাক পরলেই হইচই করে কুৎসা ছড়িয়ে দেন সংকীর্ণ মানসিকতার লোকেরা। শুধু তাই নয়, যদি কোনও মেয়ে তার পা প্রসারিত করে বসে থাকে, তাহলে তাও যৌনতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। যারা মেয়েদের পা ছড়িয়ে বসে থাকাকে অশোভন বলে অভিহিত করেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, এই ধরনের মেয়েরা ভালো বাড়ির মেয়ে নয়। তাদের মধ্যে সংস্কার ও মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। তাদের ধারণা, মেয়েরা এ ধরনের আচরণ করে ছেলেদের আকৃষ্ট করার জন্য।

আসলে, এই নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে কোনও ভাবে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এর জন্য পর্যায়ক্রমে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনেও নানা ভাবে বাধা দেওয়া হয়, তাদের উপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় এবং অপমান করা হয়। আর যে-মেয়েরা এইসব অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে, তাদেরকে নানারকম ভাবে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা জারি রাখে সমাজের ধান্দাবাজ লোকেরা।

মেয়েদের অপমান করার ক্ষেত্রে সমাজের ভদ্রবেশী কিছু মানুষেরও একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে। তারা মেয়েদের হাতের পুতুল ভাবেন এবং সেই ভাবেই তাদের সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করেন। পুতুলনাচের মঞ্চে যেভাবে পুতুলগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করা হয় সুতো দিয়ে, ঠিক সেই ভাবেই স্বার্থান্বেষীরা মেয়েদের স্বাধীনতার লাগাম রাখতে চান তাদের হাতে। এমনকী, মেয়েরা কী ভাবে হাসবেন, কোথায় যাবেন, কখন যাবেন, কখন বাড়ি ফিরবেন, সে সম্পর্কেও ধান্দাবাজরা কঠোর নিয়ম বলবৎ করার চেষ্টা করেন।

ভাবতে অবাক লাগে যে, আজকের উন্নত প্রযুক্তি এবং আধুনিক যুগে বাস করেও, প্রতিটি মেয়েকে তার জীবনের কোনও না কোনও সময়ে পরিবারের শাসন মেনে চলতে হয়। এইসব নিয়ম এই জন্যই মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সহজেই তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

অনেক সময় নিজের বাড়িতেই মেয়েদের অসম্মান এতটাই বেড়ে যায় যে, পরিবারের সদস্যরাই মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। এটি প্রায়শই কম শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল লোকদের বাড়িতে বেশি ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু কোনও মেয়েকে ‘খারাপ স্বভাবের’ ধরে নেওয়া কিংবা সন্দেহ করা মানেই হল, সেই মেয়েটির চরিত্র সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার সমান। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সমাজ ‘আধুনিক’ তকমা পাওয়া সত্ত্বেও, নারীদের জন্য অপমানজনক শব্দ আজও কেন ব্যবহার করা হয়? কেন তাদের অহেতুক সন্দেহ করা হয়? কেন সরলীকরণ নীতিতে সব মেয়েদেরই ‘খারাপ মানসিকতা’-র ভাবা হয়? কেন তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয় ?

প্রকৃতপক্ষে যারা খারাপ, তারা কিন্তু অপরাধ করেও শাস্তি পান না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। অথচ, কোমল হৃদয়ের সংবেদনশীল মেয়েরা স্বার্থান্বেষী লোকেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে পারেন না বলেই হয়তো বৈষম্য কিংবা অত্যাচারের শিকার হয়ে চলেছেন আজও।

আসলে, যারা তাদের বাড়িতে মেয়ে এবং মহিলাদের অপমান করেন, তারা বুঝতে পারেন না যে, এর ফলে তারা নিজের জন্যই বিপদ ডেকে আনছেন। কারণ, যে মেয়েরা বাড়িতে অপমান ভোগ করেন, তারা আর সেই বাড়িতে পা রাখতে চান না। এমনকী তাদের মনের কোমল প্রবৃত্তিগুলি হারিয়ে যায়। তাদের মন বিষিয়ে ওঠে। তারা আর কাউকে ভালোবাসতে পারেন না, বিশ্বাস করতে পারেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, বৈষম্যের শিকার হওয়া মেয়েদের এই করুণ পরিণতির কুফল কি সমাজে প্রতিফলিত হবে না?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...