শঙ্খশুভ্র কাল প্রাইভেট টিউশনের পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছে। পকেটে এখনও দু হাজার টাকা আছে। হিসেবের কড়ি থেকে সে পাঁচটা একশো টাকার নোট কোজাগরির হাতে তুলে দিল। যদিও টাকাটা দেওয়ার পর মনে একটা খটকা লাগল। মেয়েটা তাকে ব্ল্যাকমেল করছে না তো? তা ছাড়া সে কি ওর কেনা গোলাম যে, টাকা চাইলেই দিতে হবে। হঠাৎ পট পরিবর্তন। কোজাগরি টাকাটা নিয়ে সিগারেটের দোকানের লুঙ্গি আর শার্ট পরা হিন্দুস্তানি লোকটাকে দিয়ে বলল, ‘তোর মালিককে বলিস আর যেন আমার পিছনে না লাগে।’
সে কথা শুনে লোকটা মুখিয়ে উঠল, ‘যা যা রেন্ডী কাঁহিকা।’
কোজাগরি হঠাৎ ত্রিনয়নী দুর্গা হয়ে রাগে জ্বলে উঠে হিন্দুস্তানি লোকটাকে একটা চড় মেরে বসল।
—এই রেন্ডী মাগির পা চাটতে আসিস কেন? লজ্জা করে না?
—ঠিক হ্যায়, দেখ লেগা। লোকটা চড়টা হজম করে বলল।
কোজাগরি রেগে গেলে যে সাংঘাতিক ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে শঙ্খশুভ্রর জানা ছিল না। কোজাগরি তার মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “যা যা, ঘাস ছিঁড়বি’।
এই মুহূর্তে ওকে দেখে শঙ্খশুভ্রর দশভুজা দেবী দুর্গার কথা মনে এল। একটু পর কুলিয়া ট্যাংরা বস্তির সরু গলির মধ্যে এসে কোজাগরি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শঙ্খশুভ্র অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। এখানে এলে কে বলবে কলকাতা ভারতবর্ষের একটা বড়ো শহর। উন্নয়নের ছিটেফোঁটা যে নেই তা এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় চলতে গিয়ে মনে হল। আবছা আলো আর পচাখালের দুর্গন্ধে ভরা রাস্তায় চলতে গিয়ে শঙ্খশুভ্রর মনে হল যেন সে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে এসেছে। চারিদিকের নোংরা পরিবেশ দেখে মনে হয়। এখানে মনুষ্যত্বকে কেউ কবর দিয়েছে।
একটা বাচ্চা ছেলে ঝুপড়ির কাছে বসে তারস্বরে চিৎকার করছে। বোধহয় ওর খিদে পেয়েছে। ওকে খেতে দেবে তেমন কেউ ধারে কাছে নেই। কে যে ওর মা আর কে যে ওর বাবা বোঝা মুশকিল। অথচ ছিটেবেড়ার ঝুপড়ির ভিতর কারা যেন হুল্লোড় করছে। চোলাই মদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। উকি দিতেই বোঝা গেল ঘরের মানুষগুলো এখন নেশায় মত্ত। মেয়েমানুষের উচ্চস্বরে হাসির শব্দও ভেসে এল কানে। বাচ্চাটির দিকে ফিরে তাকাবার ফুরসত কারওর নেই।
শঙ্খশুভ্রর বুক ফুঁড়ে একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়তেই, কোজাগরি তার হাত ধরে একটা দরমার বেড়া দেওয়া রে নিয়ে এল। ছিটে বেড়ার ঘর, মাথার উপর টালি। একটা ঘরকেই পার্টিশন করে দু-ভাগ করা হয়েছে। পাশের ঘরের মেঝেতে কে যেন শুয়ে আছে। জিরো পাওয়ারের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় তার কঙ্কালসার চেহারাটা যেন ঠিক ঘাটের মড়ার মতো। কোজাগরির সাড়া পেয়ে সেই মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার হল। মানুষটা একটু নড়েচড়ে উঠল।
কোজাগরি আলোটা জ্বালিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে আজ বাঁচালে।ঘর ভাড়ার টাকাটা দিতে না পারলে কালই এ ঘর ছেড়ে রাস্তায় চলে যেতে হতো। আচ্ছা বলতে পারো অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে আমি কোথায় যাই।’
—তোমার স্বামীর কী হয়েছে?
—চামড়ার কারখানায় কাজ করে টিবি রোগ বাঁধিয়েছে।
—হাসপাতালে দাওনি কেন?
—যেতে চায় না। ও আমার কাছে থেকেই মরতে চায়। তুমি তক্তপোশে উঠে বোসো। আমি সন্ধেটা দিয়ে নিই।
টেবিলে লক্ষ্মী-নারায়ণের বাঁধানো ফটো। কোজাগরি শাঁখ বাজিয়ে গলায় আঁচল দিয়ে গড় করে প্রণাম করল। একটা ধূপ জ্বালিয়ে ফটোর কাছে রেখে দিল। আশ্চর্য এখন ওকে দেখে কে বলবে সেই হিন্দুস্তানি লোকটার অশ্লীল কথা শুনে সে জ্বলে উঠেছিল। সন্ধ্যারতি সেরে কোজাগরি হাতের ইশারায় শঙ্খশুভ্রকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের ঘরে চলে গেল।
কান পাততেই কোজাগরির গলা শোনা গেল— দুধ পাউরুটি খেয়েছিলে?
কঙ্কালসার মানুষটা ক্ষোভে ফেটে পড়ল, ‘খেয়ে আর কী হবে। আমি মরলে তো তোমার হাড়মাস জুড়োবে। চুটিয়ে ব্যাবসা করতে পারবে।’
—চুপ করো। পাশের ঘরে লোক আছে।
—ও আজকাল ঘরেও লোক আনা শুরু করেছ।
—হ্যাঁ এনেছি। তা নইলে তো কাল আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হতো। ওই লোকটাই ভাড়ার টাকা দিয়ে আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছে। লোকটা চুপ করতেই মনে হল যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল।
একটু পরে আবার কোজাগরির কথা শোনা গেল, ‘ওষুধটা খেয়ে নাও।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ। পচাখালের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক ভেসে আসছে। বস্তির মানুষগুলোর হুল্লোড়ও গেছে কমে। জানলা দিয়ে জোনাকি পোকা ঢুকে উড়তে শুরু করে দিল মনের আনন্দে। শঙ্খশুভ্রর হাতের ঘড়িতে এখন সাড়ে আটটা বাজে। বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা তার স্বভাব নয়। তার কারণ সে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তার পথ চেয়ে বসে থাকে মা। কোজাগরির তো দরকার মিটে গেছে। তাহলে তাকে বসিয়ে রাখার কারণটা কী। ওর কি অন্য কোনও মতলব আছে। নারী চরিত্র বোঝা বড়ো মুশকিল। শঙ্খশুভ্র বাড়ি ফেরার জন্য উসখুস করতেই কোজাগরি ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করেই বলে উঠল, ‘মানুষটাকে আজ রাতের মতো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। কাল সকালের আগে ওর ঘুম ভাঙবে না।”
—আমি তা হলে যাই। বলে শঙ্খশুভ্র ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে পড়তেই কোজাগরি বলল, “তা কি হয়। কিছু নিলে কিছু দিতে হয়। তোমাকে তো আমার কিছু দেওয়া হয়নি।”
এরপর কোজাগরি যা করল তার জন্য শঙ্খশুভ্র একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তাকে অবাক করে দিয়ে কোজাগরি নিজেকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে কাছে এসে বলল, ‘তুমি আজ আমার জন্য যা করেছ, জীবনে কোনওদিন ভুলব না। আমার এই দেহটা ছাড়া তোমাকে দেওয়ার আর কিছু নেই।’
নারী যখন শাড়ি পরে থাকে তার আসল রূপ ধরা পড়ে না। নগ্ন হলেই তার রূপ যৌবন প্রস্ফুটিত হয় পদ্মের পাপড়ির মতো। কোজাগরিকে দেখতে খুবই সুন্দর, তার উপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সামনে দাঁড়ানোয় যৌবনের দ্যুতিতে তাকে স্বর্গের অপ্সরা বলে মনে হল। আর্ট কলেজের ক্লাসে বসে দূর থেকে নগ্ন নারীর মডেলকে দেখে শঙ্খশুভ্রকে একবার ছবি আঁকতে হয়েছিল। তাও মাত্র আধ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া ছিল। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে কি তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে মনের মতো জীবন্ত ছবি আঁকা যায়। আজ এই মুহূর্তে কোনারকের খোদাই করা নগ্ন নারীর মূর্তির মতো কোজাগরিকে দেখে শঙ্খশুভ্রর শিল্পীমন সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠল। সে মোহগ্রস্তের মতো কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কোজাগরির চিবুকটা তুলে ধরে বলল, ‘আমাকে একটু সময় দেবে? তোমার একটা ছবি আঁকব।’
—তুমি আর্টিস্ট? বেশ তো বলো আমি কেমন পোজ নিয়ে দাঁড়াব? আজ তো সারারাত আমি শুধু তোমার। কোজাগরি শঙ্খশুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে বলল।
শঙ্খশুভ্র তাকে টুলে বসার অনুরোধ করে মেঝেতে বসে পড়ল। ব্যাগ থেকে আর্ট পেপার বার করে পেন্সিল দিয়ে সামনে বসা নগ্ন কোজাগরির স্কেচ আঁকতে শুরু করল। অনেক রাত হয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। সে তখন কোজাগরির হরিণের মতো চোখ, গ্রীবা, বটফলের মতো স্তনবৃত্ত আর পদ্মফুলের মতো যোনিদ্বার আঁকতে ধ্যানমগ্ন।
ছবিটা আঁকা শেষ হলে শঙ্খশুভ্র কোজাগরিকে দেখিয়ে বলল, “দ্যাখো তো তোমার ছবি ঠিক আঁকতে পেরেছি কি না।”
কোজগরি ছবিটা হাতে নিয়ে বলল, “ওমা তুমি আমার কী সুন্দর ছবি এঁকেছ গো। তুমি সত্যি খুব বড়ো আর্টিস্ট।আচ্ছা ছবি এঁকে তোমার যখন নাম ডাক হবে তখন তোমার আমার কথা মনে থাকবে তো?”
শঙ্খশুভ্র কোজাগরির হাত থেকে ছবিটা নিয়ে ফোল্ড করে ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, ‘সত্যি যদি আমার তেমন কিছু হয় আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসব। প্রমিস।’
—একটু দাঁড়াও, বলে কোজাগরি শাড়িটা পরে টিনের ট্রাংক থেকে একটা ভেলভেটের ব্যাগ বার করল। তারপর ব্যাগের চেনটা খুলে একটা বাদামি রঙের মৃগনাভি বার করে শঙ্খশুভ্রর হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমাকে ভুলে গেলেও এই সামান্য উপহারটা তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। ভয় নেই এটা কোনও চুরি করা জিনিস নয়। একজন আমেরিকান সাহেব আমার ঘরে এসেছিল। সে আমাকে দিয়েছে।
শঙ্খশুভ্র বাইরে বেরিয়ে দেখল আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মৃগনাভির গন্ধে ম ম করছে সমস্ত পৃথিবীটা।
(সমাপ্ত)