ভিত মজবুত করা জরুরি। তাই, শিশুদের চাই সম্পূর্ণ পুষ্টি। কিন্তু যারা মা হতে চলেছেন কিংবা হয়েছেন, তারা তাদের বাচ্চাদের কী খাওয়াবেন, তাই নিয়ে চিন্তায় থাকেন। কারণ, বাচ্চারা সব খাবার খেতে চায় না, কিন্তু তাদের শরীরে পুষ্টির জোগান দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শরীর এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য কোন বয়সের বাচ্চাদের কী খাওয়ানো উচিত, সেই হেলদি ডায়েট প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন কনসালটেন্ট জিআই সার্জন ডা. সঞ্জয় মণ্ডল।
শিশুর প্রথম আহার
সদ্যোজাতদের প্রথম এবং প্রধান আহার হল মায়ের বুকের দুধ। হালকা হলুদ রং-এর এই দুধ শিশুর আদর্শ খাবার। এই দুধকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক। শিশুদের ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করে এই দুধ। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং শরীরে পুষ্টি ও শক্তি জোগায়। মা হওয়ার এক ঘণ্টা পর থেকে শিশুকে খাওয়াতে পারেন এই দুধ। মনে রাখবেন মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই।
৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের আহার
জন্ম নেওয়ার পরই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তন্ত্র বিকশিত হয় না এবং খাবার হজম করানোর ব্যাক্টেরিয়াও পাকস্থলীতে থাকে না। তাই শিশুখাদ্য এমন হওয়া চাই, যা হালকা, সুপাচ্য এবং পুষ্টিকর। মায়ের বুকের দুধে থাকে সঠিক মাত্রায় শর্করা, জল এবং প্রোটিন। এসব শিশুর স্বাস্থ্য এবং বিকাশের জন্য জরুরি। মায়ের দুধে এইসব উপাদান থাকার কারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরামর্শ দিয়েছে, ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো আবশ্যক ।
৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত বেবি ডায়েট
৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত শিশুদের মিনারেলস, ভিটামিন প্রভৃতির ভীষণ দরকার। কারণ এই বয়স সঠিক বিকাশের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠার সময়। অনেক বাচ্চা এই সময় অ্যানিমিয়াতে আক্রান্ত হয়। তাই অ্যানিমিয়া আটকাতে পুষ্টিকর খাবার জোগান দেওয়া জরুরি। বাচ্চা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব মা-বাবার। তাই এই বয়সের শিশুদের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে কলা, গাজর, রাঙাআলু, আলু, মটর প্রভৃতি। এসবের মিশ্রণে তৈরি চিকেন স্যুপ খাওয়ানো জরুরি। সেইসঙ্গে চিনি ছাড়া দই, ওটস প্রভৃতি খাওয়ানো যেতে পারে।
১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত
সকালের খাবার: ভালো মানের বিস্কুট জলে ভিজিয়ে খাওয়ান প্রথমে। তারপর দুধে ভিজিয়ে খাওয়ান স্যাঁকা ব্রেড এবং কাঠালি কলার অর্ধেক।
দুপুরের খাবার: ভাতের সঙ্গে আলু, পেঁপে, গাজর, বিন্স প্রভৃতি সেদ্ধ করা সবজি চটকে, অল্প মাখন মাখিয়ে খাইয়ে দিন। সেইসঙ্গে খাওয়ান সেদ্ধ ডিমের কুসুম।
রাতের খাবার: ডাল, ব্রাউন রাইস, সবজি প্রভৃতির খিচুড়ি বানিয়ে খাইয়ে দিন।
২ থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত
স্তন্যপান বন্ধ হওয়ার পর শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো জরুরি। কারণ এই সময় শরীর এবং মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হয়। তাই, জেনে নিন কোন বয়সের শিশুর কতটা ক্যালোরির প্রয়োজন-
২ থেকে ৩ বছর : ১০০০-১১০০ ক্যালোরি
৩ থেকে ৫ বছর : ১১০০-১২০০ ক্যালোরি
৫ থেকে ৮ বছর : ১২০০-১৪০০ ক্যালোরি
৮ থেকে ১২ বছর : ১৪০০-১৬০০ ক্যালোরি (মেয়েদের জন্য) এবং ১৬০০-১৯০০ ক্যালোরি (ছেলেদের জন্য)।
পুষ্টির মাত্রা
কার্বোহাইড্রেট— সবজি থেকে ৩৩ শতাংশ
ভিটামিন এবং মিনারেলস— ফল এবং সবজি থেকে ৩৩ শতাংশ
আমিষ নিরামিষ প্রোটিন— ১২ শতাংশ
ডেয়ারি প্রোটিন— ডেয়ারিজাত দ্রব্য থেকে ১৫ শতাংশ
শর্করা— মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য থেকে ৭ শতাংশ।
জল
২ থেকে ৩ বছর: ১ থেকে ২ গেলাস ৩ থেকে ৫ বছর : ২ থেকে ৩ গেলাস
৫ থেকে ৮ বছর: ৩ থেকে ৪ গেলাস ৮ থেকে ১২ বছর : ৪ থেকে ৫ গেলাস
(১ গেলাস: ২৫০ মিলিলিটার)।
পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং ভিটামিনের জন্য অঙ্কুরিত মুগ, অঙ্কুরিত ছোলা, আপেল, বেদানা, আঙুর, ডিমের কুসুম প্রভৃতি উপযুক্ত আহার।
সতর্কতা
আজকাল জাংক ফুড খুব পছন্দ করে বাচ্চারা। কিন্তু এই জাংক ফুড অত্যন্ত ক্ষতিকারক। জাংক ফুড বেশি খেলে শরীরে তার কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। এই জাংক ফুড-এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার। তাই, জাংক ফুড থেকে দূরে রাখুন বাচ্চাদের। ওদের খাওয়ান বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার। সবুজ শাকসবজি এবং ফল খাওয়ান যাতে পুষ্টির ঘাটতি না হয়, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকুন। সফ্ট ড্রিংক যাতে বেশি পান না করে, তাও দেখা উচিত। বিশুদ্ধ জল পানে যাতে ঘাটতি না হয়, সেই ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিদিন অন্তত একবার, বিশেষ করে দুপুরে খাওয়ানোর পর, ফলের জুস খাওয়াতে হবে বাচ্চাদের। খাদ্য তালিকা থেকে মাছ, মাংস এবং ডিমও যাতে বাদ না যায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা চাই।
শিশু, খাদ্য এবং পুষ্টি
শিশুরা খুব চটকদার খাবার খেতে ভালোবাসে। তারা কী খেতে চায়, অনেক সময় তা বোঝা খুব কঠিন।
আমাদের দেশে নিম্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রায়ই দেখা যায় যে, শিশুদের নিয়মিত খাবারের সুযোগ নেই। এটি প্রায়শই দরিদ্র এবং অন্যান্য সামাজিক কারণে ঘটে। তাই তারা অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রচুর ভিটামিনের ঘাটতি রয়েছে। সমাজের এই স্তরের বেশিরভাগ পিতামাতার মধ্যে এটি একটি খুব সাধারণ এবং ভুল ধারণা যে, খাবার দামি মানেই ভালো এবং কম দামি খাবার ভালো নয়।
অনেকগুলি খাদ্যপণ্য রয়েছে যা খুব স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর কিন্তু মোটেই ব্যয়বহুল নয়। যেমন ডিম, সাধারণ শাকসবজি, চিনাবাদাম, গুড় ইত্যাদির মতো খাবার, দামেও সস্তা এবং স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর। মরশুমি ফল স্বাস্থ্যের জন্য সমান ভাবে ভালো এবং অনেক সময় খুব একটা দামিও হয় না। মাছ আবার এমন একটি পণ্য, যা খুব স্বাস্থ্যকর এবং সব মাছ ব্যয়বহুল নয়। ব্যয়বহুল মানে সবসময় স্বাস্থ্যকর নয়।
অন্যদিকে উচ্চতর আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রচুর সমস্যা রয়েছে। যদিও সেখানে পুষ্টির অভাবও রয়েছে। তবে বেশিরভাগ শিশুই প্রচুর পরিমাণে অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক ফুড খায়, যা ব্যাপক ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতার দিকে পরিচালিত করে। আর এই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে শিশুরা শরীরে রোগজীবাণু নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। একবার এই শিশুরা এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তারা পরবর্তী পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর খাবারে পরিবর্তন করতে পারে না।
বিশেষ পরামর্শ
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা তাদের যা শেখাই, তারা তা-ই শেখে। খাবার খাওয়ার বিষয়টিও একইরকম ভাবে শিক্ষণীয় বিষয়। তাই তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের জীবনধারা কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, তারা ছোটোবেলায় যা শিখবে, যেভাবে শিখবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাদের থেকে ঠিক একই ভাবে শিখবে এবং প্রভাবিত হবে। অতএব, শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রচুর প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট-এর প্রয়োজন। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি এবং স্ট্রেসফুল লাইফস্টাইলের কারণে
বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের রেডিমেড ইনস্ট্যান্ট ফুড প্রোডাক্ট দিয়ে সহজ উপায় বের করার প্রবণতা রাখেন। এছাড়াও বাচ্চাদের সন্তুষ্ট রাখতে তারা প্রচুর চিনিযুক্ত খাবার, যেমন— চকোলেট, বিস্কুট, সিন্থেটিক জুস, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি খাওয়ান, যা স্পষ্টতই বাচ্চাদের জন্য খুব লোভনীয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও নুডলস, পিজ্জা, বার্গারের মতো খাবারগুলি প্রায়ই খাওয়ানো হয় বাচ্চাদের এবং এগুলি কেবল বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকারক। যে খাবারগুলো নতুন করে তৈরি করা হয় না, সেগুলোতে প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল কালার থাকে, যা খুবই ক্ষতিকর। এই পণ্যগুলি শৈশবে রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তাজা তৈরি করা পুষ্টিকর স্ট্যান্ডার্ড ভারতীয় খাবার যেমন ভাত, শাকসবজি, ডাল প্রভৃতি শিশুদের জন্য খুবই ভালো। পশ্চিমের খাবারগুলি স্বাস্থ্যের জন্য একেবারেই ভালো নয়। যেমন ব্রেড-এর পরিবর্তে প্লেইন আটার রুটি খাওয়ানো উচিত। সংরক্ষিত খাবার, জাংক ফুড, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি একেবারে এড়িয়ে চলতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাচ্চাদের প্রিয় জাংক ফুড খাওয়ার চাহিদা না বাড়িয়ে, তাদের স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস তৈরি করানো উচিত। তাই, বাড়িতে জাংক ফুড রাখা বন্ধ করুন এবং পরিবর্তে টেবিলে ফল রাখুন, যাতে বাচ্চাদের খিদে পেলে জাঙ্ক ফুড, স্ন্যাকস, চকোলেট বা সফট ড্রিংকস-এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর তাজা ফল খেতে বাধ্য হয়। শিশুরা তৃষ্ণার্ত হলে তাদের সাধারণ জল পান করতে উৎসাহিত করুন অথবা সম্ভব হলে ডাবের জল খাওয়ান।